Home Bangla Recent জন্মস্থান চট্টগ্রামেই সঙ্কটে গার্মেন্টস

জন্মস্থান চট্টগ্রামেই সঙ্কটে গার্মেন্টস

রফতানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পের জন্মস্থান চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামেই এখন গভীর সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে গার্মেন্টস। প্রধান সমুদ্র বন্দর ধারেকাছে। গার্মেন্টসের কাঁচামাল আমদানি এবং তৈরি পোশাক রফতানির জন্য বন্দর সুবিধা নাগালে। শিল্প-কারখানার সোনালী ঐতিহ্যের ধারক চট্টগ্রাম। সেই সুবাদে এখানে গত দুই দশকে প্রতিষ্ঠিত হয় ৭শ’রও বেশি গার্মেন্টস কারখানা। এখন পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সদস্যভূক্ত কারখানার তালিকায় আছে ৬৭৫টি। তবে বাস্তবে সচল অর্ধেকের মতো। সমন্বিত উদ্যোগে সাভার কিংবা আশুলিয়ার মতো গার্মেন্টস শিল্পজোন না থাকা, শহর-উপশহরে জমির অগ্নিমূল্য, শিল্পপ্লট ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব, যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা কারখানাগুলো কমপ্লায়েন্সের শর্ত পূরণে অক্ষমতাসহ নানামুখী জটিলতা, গ্যাস-বিদ্যুতের ঘাটতি, শ্রম অসন্তোষ, অতীতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যাংকসমূহের চট্টগ্রামে বিনিয়োগে অনীহা, বায়ারদের রাজধানী ঢাকামুখিতা ইত্যাদি বিরূপ অবস্থাকে ঘিরে চলমান এই সঙ্কট। আর এসব কারণে ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে ৩০৬টি কারখানা। রুগ্নদশায় ধুঁকছে আরও শতাধিক কারখানা। বর্তমানে কাগজে-কলমে ৩৬৯টি গার্মেন্টস কারখানা চালু বলা হলেও অবকাঠামো ও কমপ্লায়েন্সের শর্ত পরিপূরণ করে সরাসরি পোশাক রফতানিতে সক্ষম হচ্ছে প্রায় ২৫০টি কারখানা। অবশিষ্ট ১১৯টি কারখানা সাব-কনট্রাক্ট নিয়ে কোনো মতে টিকে আছে। সঙ্কট অব্যাহত থাকলে আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে আরও একশ’ থেকে দেড়শ’ কারখানার দুয়ার বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

শিল্পোদ্যোক্তাদের সূত্র জানায়, ১৯৭৮ সালে কালুরঘাট শিল্প এলাকায় গড়ে ওঠা ‘দেশ গার্মেন্টসে’র হাত ধরেই বাংলাদেশে রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের পথচলা শুরু হয়। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে গার্মেন্টসে শিল্পের সুবর্ণ সময়। তখন দেশের মোট পোশাক রফতানি প্রবাহের ৩৫ শতাংশই ছিল চট্টগ্রামের অবদান। অথচ এখন তা নেমেছে মাত্র ১৩ শতাংশে। অদূর ভবিষ্যতে সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে যেতে পারে। কালুরঘাট, নাসিরাবাদ, ডবলমুরিং, দেওয়ানহাট, সল্টগোলা রোড, সাগরিকা, পাহাড়তলী, বায়জিদ, অক্সিজেন, জুবিলি রোড, এনায়েতবাজার, চান্দগাঁওসহ বন্দরনগরী ও শহরতলীতে অবস্থিত শতাধিক গার্মেন্টস কারখানা কোন না কোন সমস্যা-সঙ্কটে ধুঁকছে। এসব জায়গায় ৩০৬টি কারখানা বিগত দুই দশকে বন্ধ হয়ে গেছে।

এরমধ্যে ২০১২ সাল পর্যন্ত চালু ৫৪৫টি কারখানার মধ্যে বন্ধ হয় ১৩৪টি। ২০১৩ সালে চালু থাকা ৫৩৩টি কারখানার মধ্যে বন্ধ হয় ২২টি। ২০১৪ সালে চালু ৪৮৮টি কারখানার মধ্যে বন্ধ হয় ৪৫টি। ২০১৫ সালে সচল ৪৫৬ কারখানার মধ্যে বন্ধ হয় ৩২টি। ২০১৬ সালে চালু থাকা ৪০৫টি কারখানার মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ৫১টি। আর চলতি ২০১৭ সালে চলতি মে মাস পর্যন্ত চালু থাকা ৩৬৯টি কাখানার মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ২২টি। এভাবে একে একে বন্ধ হয় ৩০৬টি। কারখানা বন্ধের সাথে চট্টগ্রাম থেকে পোশাক রফতানি আয় প্রতিবছর হ্রাস পাচ্ছে। গত ২০১৪ সালে দেশে পোশাক খাতে আয়ের ১৪.৫ ভাগ আসে চট্টগ্রাম থেকে। ২০১৫ সালে তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ১৩.৬৫ ভাগ। গতবছর ২০১৬ সালে নেমে আসে ১৩.৩ শতাংশে। ২০১৬ সালে তৈরি পোশাক রফতানি খাতে মোট জাতীয় আয় হচ্ছে ২৮৬৬৮ দশমিক ২৯ মিলিয়ন ডলার। এরমধ্যে চট্টগ্রাম থেকে আয় আসে মাত্র ৩৮১২ মিলিয়ন ডলার।

মূল সমস্যা অবকাঠামো ও কমপ্লায়েন্স:

গার্মেন্টস শিল্পের সূতিকাগার চট্টগ্রামে এ খাতে যে অস্তিত্বের সঙ্কট বিরাজ করছে তার কারণ সম্পর্কে বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী গতকাল রোববার ইনকিলাবকে জানান, অবকাঠামোর অভাব এবং কমপ্লায়েন্সের শর্ত পূরণে অক্ষমতা মূল সমস্যা। চট্টগ্রামে শিল্পের জন্ম হলেও সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে শিল্পায়নের সুযোগ কাজে লাগানো হয়নি। বিগত ৪০ বছরেও গড়ে উঠেনি গার্মেন্টস শিল্প জোন। জমির দাম অনেকগুণ বেড়ে যাবার ফলে শিল্প মালিকরা এককভাবে ও সুপরিকল্পিত পরিবেশে কারখানা স্থাপন করতে পারেননি। অথচ এরজন্য বাণিজ্য, শিল্প, ভূমি, বস্ত্রসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো সমন্বিতভাবে এগিয়ে এসে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি। এ অবস্থায় বাসাবাড়ি, মার্কেট, ভাড়া ঘরে যত্রতত্র অপরিকল্পিত ও বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে উঠেছে চট্টগ্রামের কারখানাগুলো। এরমধ্যে শুধু কালুরঘাট ও সাগরিকা বিসিক শিল্প এলাকায় কিছু কারখানা প্রতিষ্ঠিত হলেও আয়তনে ছোট। কারখানা সংকুলান হয়েছে কম। চট্টগ্রাম শহরের বাইরে হাটহাজারী ও কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে সুবিধাজনক জায়গা বাছাই করে পরিকল্পিত গার্মেন্টস ভিলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায়, সিটি কর্পোরেশন ও সিডিএর পক্ষ থেকে শুধুই আশ্বাস দেয়া হচ্ছে দীর্ঘদিন। কিন্তু তা অনিশ্চিত অবস্থায় ঝুলে আছে।

তিনি আরও জানান, রানা প্লাজা ধসের ঘটনার প্রেক্ষাপটে ২০১৩ সাল থেকে গার্মেন্টস শিল্পের জন্য উপযুক্ত অবকাঠামোর অপরিহার্যতা অর্থাৎ ‘অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্স’ এবং ‘এনএপি (আইএলও)’ নীতিমালার আলোকে কমপ্লায়েন্সের শর্তাবলী পূরণের বিষয়টি সামনে চলে আসে। কিন্তু তার আলোকে কমপ্লায়েন্স শর্ত পূরণে অক্ষম হয় অনেক কারখানা। এ অবস্থায় নন-কমপ্লায়েন্সের অগ্রহণযোগ্য কারখানা মালিকরা একে একে গুটিয়ে চলে যেতে বাধ্য হন। শুধু কমপ্লায়েন্স জটিলতাতেই চট্টগ্রামে এ যাবৎ বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় একশ’ কারখানা। রুগ্ন ও বন্ধের মুখোমুখি রয়েছে আরো প্রায় সমসংখ্যক কারখানা।

শিল্প মালিক-রফতানিকারক সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে রফতানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পে চলমান কঠিন পরিস্থিতির পেছনে আরও কারণ রয়েছে। এ খাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ মিলছে না। বরং গ্যাস-বিদ্যুতের ঘন ঘন আসা-যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। চট্টগ্রামে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের বাইরেও কারিগরি গোলযোগের ‘ক্রনিক’ সমস্যার শিকার গার্মেন্টস শিল্প। হঠাৎ করে ট্রান্সফরমার অচল আবার কোথাও পুরনো জরাজীর্ণ যন্ত্রপাতি, সিটি সার্কিট ব্রেকার, সঞ্চালন লাইনে জোড়াতালি মেরামত এসব কারণে ঘন ঘন ‘লোকালশেডিং’ হচ্ছে। বিদ্যুৎ সরবরাহের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বিগড়ে যাওয়ার কারণে গর্মেন্টস কারখানাগুলো নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন বজায় রাখতে হিমসিম খাচ্ছে। বিদ্যুৎ সঙ্কটের বিকল্প হিসেবে কারখানায় ডিজেল পুড়িয়ে জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদনের চাকা সচল রাখতে গিয়ে বিদ্যুৎ ব্যয়ের তুলনায় দ্বিগুণ বাড়তি বোঝা টানতে হচ্ছে। এতে করে লোকসান গুণছে পোশাক খাত। নগরীর প্রায় সর্বত্র যান্ত্রিক সমস্যার কারণে বিদ্যুতের লো-ভোল্টেজ উৎপাদন ব্যাহত করছে। এতে করে কারখানার মেশিনারিজ বিনষ্ট হচ্ছে।

গার্মেন্টস কারখানাগুলো সার্বক্ষণিক চালু রাখার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা গ্যাসের সঙ্কট। চট্টগ্রামে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক সাড়ে ৫শ’ মিলিয়ন ঘনফুট। আর ন্যুনতম চাহিদা ধরা হয় ৪শ’ ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু গ্যাসের সরবরাহ মিলছে মাত্র ২২০ থেকে ২৮০ মিলিয়ন ঘনফুট। এ অবস্থায় জাতীয় গ্রিডের সরবরাহের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি. (কেজিডিসিএল)-কে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে কারখানায় উৎপাদনশীলতা সচল ও বন্দরের লিড টাইম ঠিক রেখে রফতানি চালান জাহাজীকরণে অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। তাছাড়া গার্মেন্টস পণ্য আমদানি ও রফতানি প্রক্রিয়ায় বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোসমূহ (আইসিডি) তথা অফডকের বিভিন্নমুখী অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, যন্ত্রপাতি ঘাটতির খেসারত দিচ্ছে কারখানাগুলো।

এদিকে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে গার্মেন্টস শিল্পকে সেই ১৯৭৮-১৯৯৫ সালের সুবর্ণ যুগে ফিরিয়ে নিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান আরও বৃদ্ধির লক্ষ্যে সমন্বিত উদ্যোগের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেছেন, গার্মেন্টস শিল্পে অবকাঠামোর অপরিহার্য দিক অর্থাৎ ‘অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্স’ এবং ‘এনএপি (আইএলও)’ নীতিমালার আলোকে কমপ্লায়েন্সের শর্ত পূরণ না করে এখন আর কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে ঘাটতি বা অক্ষমতার কারণে আগামী ২-৩ বছরে চট্টগ্রামে একশ’ থেকে দেড়শ’ এমনকি ২শ’ পর্যন্ত কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এসব কারখানা বাঁচিয়ে রাখতে চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও কর্ণফুলীর ওপাড়ে সুবিধাজনক পর্যাপ্ত জায়গা বরাদ্দের মাধ্যমে আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন গার্মেন্টস ভিলেজ স্থাপন করা প্রয়োজন। এরজন্য পিপিপি’র (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বমূলক) ভিত্তিতে শিল্প এলাকা বা ভিলেজ গড়ে তুলতে এখনই দরকার উদ্যোগ। এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে (বাণিজ্য, শিল্প, ভূমি, বস্ত্র) মনিটরিং ও সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিকল্পনা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের গার্মেন্টস শিল্প মালিকদের সুদীর্ঘ প্রায় ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে রফতানি আয় বৃদ্ধির মহাসুযোগ তৈরি হবে।

শিল্প মালিকরা জানিয়েছেন, চট্টগ্রামে অবকাঠামো ও কমপ্লায়েন্সের অনিশ্চয়তায় থাকা কারখানাগুলো স্থানান্তর (রি-লোকেট) করা ছাড়া টিকবে না। এর জন্য গার্মেন্টস ভিলেজ স্থাপনের বিকল্প নেই। তাছাড়া দেশের গার্মেন্টস পণ্যের রফতানি প্রবাহ বাড়াতে হলে এ শিল্পের সূতিকাগার চট্টগ্রামে অবস্থান আরও সুসংহত এবং প্রসারিত করা অপরিহার্য। কেননা গার্মেন্টস পণ্য রফতানি আয়ে অনেক বছর পর বিগত ৮ মাসে হঠাৎ করে নেতিবাচক ধারা অশনি সঙ্কেত বহন করে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি আরও বাড়ানোর সুযোগ অবারিত রয়ে গেছে। শীর্ষে অবস্থান বজায় রেখে বিশ্ববাজারে চীনের পোশাক রফতানি ৩২ শতাংশ (সাড়ে ৪শ’ বিলিয়ন ডলার)। আর বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের রফতানি মাত্র ৫ শতাংশ (২৮ বিলিয়ন ডলার)। অথচ এই রফতানি বাজারের আওতা ও আয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে চট্টগ্রামে শিল্পখাতটি ঘুরে দাঁড়াতে পারলে সেই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here