Home Bangla Recent পোশাকের ন্যায্য মূল্য দেয় না বিদেশিরা

পোশাকের ন্যায্য মূল্য দেয় না বিদেশিরা

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৪ বছর

‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনা নিয়ে অনেক বিষয়ে আলোচনা হলেও পোশাকের ন্যায্য দাম নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। অথচ শ্রমিকের অধিকারসহ এ খাতকে শক্তিশালী করতে হলে তৈরি পোশাকের দাম  বাড়ানোর বিকল্প নেই। বাংলাদেশ থেকে পাঁচ মার্কিন ডলারে পণ্য কিনে তা ২৫ ডলারে বিক্রি করা হচ্ছে। আমরা পাঁচ ডলার নিয়ে আলোচনা করছি কিন্তু বাকি ২০ ডলার কোথায় যায় তা নিয়ে কারো কোনো কথা নেই। ’ রানা প্লাজা দুর্ঘটনার চার বছর পূর্তি উপলক্ষে গতকাল রবিবার রাজধানীর গুলশানের গার্ডেনিয়া গ্র্যান্ড হলে আয়োজিত সামাজিক সংলাপে এসব কথা বলেছেন সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) যৌথভাবে এই সংলাপের আয়োজন করে।

সভাপতির বক্তব্যে সিপিডির চেয়ারম্যান বলেন, ধারাবাহিক জবাবদিহির ঘাটতির ফল রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি। সরকার ও প্রশাসনের দুর্বলতা ও জবাবদিহির অভাব ছিল। রাজনৈতিকভাবে নজরদারির অভাব ছিল। গত চার বছরে ইস্যুটি নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক আলোচনা হয়েছে। অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স কাজ করেছে। সেই তুলনায় সরকারের শীর্ষপর্যায়ে তেমন আলোচনা হয়নি।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিনিধিদলের উপপ্রধান ইয়োগান হেইম্যান বলেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের কর্মপরিবেশের অগ্রগতি নিয়ে আগামী ১৮ মে ইউরোপীয় ইউনিয়নে আলোচনা হবে। সেই বৈঠকের ফল যদি নেতিবাচক হয়, তবে ইউরোপের বাজারে যে অগ্রাধিকার সুবিধা বাংলাদেশ পায়, তাতে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে।

সিপিডির সম্মানীত ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর ট্রেড ইউনিয়ন, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিয়ে যে পরিমাণ অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। তবে এই ঘটনার পর দেশে ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু কার্যকারিতা কম। তিনি অভিযোগ করেন, ক্ষতিগ্রস্তরা পর্যাপ্ত সাহায্য-সহযোগিতা পায়নি; তাদের পুনর্বাসনও হয়নি।

শ্রমসচিব মিকাইল সিপার বলেন, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর সরকার যথেষ্ট সচেতন হয়েছে। ভবিষ্যতে শ্রমিকদের উন্নয়নে উদ্যোগ নিতে সচেষ্ট সরকার। তিনি বলেন, ‘আগামী ১৮ মে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যে আলোচনা হবে এ বিষয়ে আমি বেশ আত্মবিশ্বাসী। আশা করি, উন্নয়ন সহযোগীদের বোঝাতে সক্ষম হব। ’

বিজিএমইএর সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘এ পর্যন্ত ৫৯১টি কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২৬০টি চালু আছে। বাকিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। কেন হলো, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। ’ তিনি বলেন, ‘ট্রেড ইউনিয়ন বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হলো আমরা আইন মানছি কি না। ’ এ ছাড়া এত ফেডারেশন না হয়ে খাতভিত্তিক একটি ফেডারেশন হওয়ার তাগিদও দেন তিনি।

পোশাকের দামের বিষয়ে মাহমুদ হাসান বলেন, বিদেশে ক্রেতারা তাদের ব্যবসা দেখবে; দাম বাড়ানোর চাপ দিলে তারা ইথিওপিয়া বা ভারতে চলে যাবে। গার্মেন্ট খাতকে এগিয়ে নিতে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে ভারত, বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিচালক শামসুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, ‘রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে। গার্মেন্ট পরিদর্শন বাড়িয়ে দিয়েছি। শ্রমিকদের ডাটা বেইস তৈরির কাজ চলছে। ’

শ্রমিক নেতা কামরুল ইসলাম বলেন, ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় বিদেশি সংস্থা থেকে ক্ষতিপূরণের একটি প্যাকেজ পেয়েছি। আইনানুগ কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি। স্পেকট্রাম গার্মেন্টস দুর্ঘটনার পর শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হলেও রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর গত চার বছরে শ্রমিকদের কোনো স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়নি। ’

শ্রমিক নেতা বাবুল আক্তার বলেন, ‘যারা মরে গেছে তারা বরং বেঁচে গেছে। যারা বেঁচে আছে তাদের নিয়ে শুধু আলাপ-আলোচনা হয়; আর কিছুই না। যতটুকু হয়েছে বিদেশিদের চাপেই হয়েছে। সরকার মন থেকে কিছু করেনি। উল্টো সামাজিক সংলাপের নামে শ্রমিকদের ডেকে নিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ’

শ্রমিক নেত্রী নাজমা বেগম বলেন, ‘সব প্রক্রিয়া দুর্নীতিতে ভরে গেছে। কিন্তু আমাদের হতাশ হলে চলবে না। সামনে জিএসপি ইস্যু কিভাবে পুনরুদ্ধার করব—সেটা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। ’

শ্রমিক নেতা তৌহিদুর রহমান বলেন, ‘অনেক শ্রমিক এখনো মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। তাঁরা কাজে যোগ দিতে ভয় পান; এমনকি বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করতেও ভয় পান। দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে সাড়ে ১৪ শতাংশ শ্রমিক কাজে যোগ দিয়েছেন। আর ৪২ শতাংশ শ্রমিক এখনো বেকার রয়েছেন। তাঁদের ফেরানোর বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। ’

সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আশুলিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। শ্রম অধিকারের বিষয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাও প্রশ্ন তুলেছে। আইএলওর গত বছরের উদ্বেগের বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, এখনো শ্রম আইনের সংশোধন, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় অবাধে ট্রেড ইউনিয়ন করার স্বাধীনতা, সব খাতে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ট্রেড ইউনিয়নবিরোধী কর্মকাণ্ডের তদন্ত করার মতো বিষয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে। প্রত্যাশা অনুযায়ী এখনো শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি।

এ সময় পরিসংখ্যান তুলে ধরা বলা হয়, ২০১৪ সালে সর্বোচ্চসংখ্যক ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন দেওয়া হলেও এর পর থেকেই তা কমছে। ২০১৪ সালে ১৮৭টি ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে দেওয়া হয়েছে যথাক্রমে ৭১ ও ১০টি।