যুক্তরাজ্য ইইউ থেকে বেরিয়ে আসায় বাংলাদেশের রফতানি খাতের সবচেয়ে বড় স্তম্ভ তৈরি পোশাক খাতে বড় ধরনের ধাক্কা আসবে। এর কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় যুক্তরাজ্যে ইইউর বিনিয়োগ কমে যাবে। একই সঙ্গে একলা চলো নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে আর্থিক খাতেও সংকোচন করতে হতে পারে। এর ফলে দেশটির কর্মসংস্থান ও জনগণের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পাবে। যথেচ্ছ ব্যয়ের প্রবণতাও কমে আসবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের ওপর।
বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণে দেশটির আর্থিক ও বৈদেশিক নীতির পরিবর্তন হতে পারে। আর তা হলে তৈরি পোশাক খাতসহ বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে বিরূপ প্রভাব পড়বে। অর্থাৎ উদারনীতির পরিবর্তে যুক্তরাজ্য যদি রক্ষণশীল নীতি বেছে নেয়, তাহলে এর প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশের ওপরও পড়বে। এতে উদ্বিগ্ন এ খাতের উদ্যোক্তারা। এর যৌক্তিক কারণও রয়েছে। ইইউর শরিক দেশ হিসেবে এতদিন যুক্তরাজ্য বাংলাদেশকে অস্ত্র ছাড়া সব ধরনের পণ্য রফতানিতে বিশেষ জিএসপি সুবিধা দিয়ে এসেছে। তৈরি পোশাক খাত হচ্ছে এসব রফতানি পণ্যের অন্যতম। এখন দেশটির প্রদেয় এ সুবিধা হারানোরও আশংকা করছেন রফতানিকারকরা। তারা বলছেন, যুক্তরাজ্য পণ্য আমদানিতে জিএসপি সুবিধা তুলে নিলে চাপে পড়বে বাংলাদেশের রফতানি খাতে। এর ফলে শুধু তৈরি পোশাক শিল্পই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, এর সঙ্গে সাব-কন্ট্রাক্টিং সবক’টি উপখাতও বাজার হারাবে। এর প্রভাব পড়বে স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যে। তাই এসব বিষয়ে এখনই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিচার-বিশ্লেষণ জরুরি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ রোববার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকার সজাগ রয়েছে। রফতানির ব্যাপারেও নতুন করে ভাবছে। তৈরি পোশাকের জন্য যে চ্যালেঞ্জ আছে তা আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। তিনি দেশটির রফতানি বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় প্রয়োজনীয় গুরুত্বারোপ করে সংশ্লিষ্টদের একটি প্ল্যাটফর্মের আওতায় কাজ করারও পরামর্শ দেন। পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, যুক্তরাজ্য হচ্ছে বাংলাদেশী পণ্যের তৃতীয় বৃহৎ আমদানিকারক। এর সিংহভাগই তৈরি পোশাক। এখন জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় এর প্রাথমিক একটা ধাক্কা তৈরি পোশাক রফতানির ওপর আসতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে যাতে এর প্রভাব না পড়ে সে ব্যাপারে এখন থেকেই সরকারের উচিত দেশটির সরকারি নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা।
জানা গেছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে ইইউ অঞ্চল। মোট রফতানি আয়ের ৬১ শতাংশই আসে এ অঞ্চল থেকে। এর মধ্যে ইইউর সবচেয়ে বড় দুই ক্রেতা দেশের একটি হচ্ছে যুক্তরাজ্য। মোট রফতানির ২২ শতাংশই আয় হয় এ দেশ থেকে। চলতি অর্থবছরে মোট রফতানি লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৮শ’ কোটি ডলারই আসবে যুক্তরাজ্য থেকে। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় দেশটির অর্থনীতিতে ধস নামতে পারে। আলাদা হওয়ার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ডলারের বিপরীতে পাউন্ড ও ডলারের বিপরীতে ইউরোর দরপতন হয়েছে। তার ওপর স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড ব্রিটেন থেকে আলাদা হতে চাইছে। যুক্তরাজ্য এ ধকল কাটিয়ে উঠতে পারবে কিনা তার ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতের ইউরো জোনের ভূ-অর্থনীতি। এ কারণে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে। নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিও হতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে মুদ্রা মানের দরপতন ঠেকানো যাবে না। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাজ্য ইইউতে থাকতে যে অগ্রাধিকার বাজার প্রবেশাধিকার (জিএসপি) সুবিধা বাংলাদেশ ভোগ করত তা ভবিষ্যতে বলবৎ থাকবে কিনা। ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপি সুবিধা যাতে বহাল থাকে সে বিষয়ে নতুন করে আলাপ- আলোচনা হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে তৈরি পোশাক খাত তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে যাবে। এমনতিতে ব্রিটেন ইইউ থেকে আলাদা হওয়ার খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ডলারের বিপরীতে পাউন্ড এবং ডলারের বিপরীতে ইউরোর দরপতন ঘটেছে যথাক্রমে ১০ শতাংশ ও ৭ শতাংশ। গত ৩০ বছরে এ ধরনের দরপতন হয়নি। ফলে ব্রিটেনে ইইউর বিনিয়োগ কমে যাবে। যার প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানে। এতে ব্রিটেনের জনগণের ক্রয়ক্ষমতাও কমে যাবে। যার প্রভাব পড়বে দেশটির পোশাক আমদানিতে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানির পর যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় ক্রেতা হওয়ায় রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে মুদ্রার দরপতন হওয়ায় বাংলাদেশী রফতানিকারকদের সক্ষমতা কমে যাবে।
নিট পেশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি আসলাম সানি বলেন, আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্তে পোশাক রফতানিতে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে প্রভাব পড়বে। স্বল্প মেয়াদে পোশাক রফতানি কমবে। দীর্ঘ মেয়াদে ইউকের ব্র্যান্ডগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়নে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ব্র্যান্ডগুলো ইউকের কী কী সুবিধা পাবে তার ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি। আবার আলাদা হওয়ার পর যুক্তরাজ্য জিএসপি সুবিধা বহাল রাখবে কিনা সে বিষয়টিও দেখতে হবে। সব মিলিয়ে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। তবে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের বিটিএমইর সহ-সভাপতি ফজলুল হক বলেন, রফতানিতে কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তা এ মুহূর্তে কিছু বলা যাবে না। তবে যেহেতু আলাদা হওয়ার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ৭ শতাংশ মুদ্রা অবমূল্যায়ন হয়েছে- তাই বলা যায়, পোশাক রফতানিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। রফতানিতে শ্লথগতি দেখা দেবে। এ চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে সরকার তৎপর হতে হবে। রফতানির নীতি-সহায়তাগুলো নিয়ে পুনরায় ভাবতে হবে।