তৈরি পোশাক রপ্তানিতে উৎসে কর কমিয়ে এবং তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের স্থান ও স্থাপনা ভাড়ার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) একেবারে তুলে দিয়ে গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদে অর্থবিল, ২০১৬ পাস হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
পাস হওয়া বিলে তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি খাতে উৎসে কর হার নির্ধারণ করা হয়েছে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট প্রস্তাবে এই কর হার ১ দশমিক ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত এই কর হার কমানো হলো প্রস্তাবিত হারের অর্ধেকের বেশি। বর্তমানে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে কর হার শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ, অর্থাৎ ১০০ টাকায় ৬০ পয়সা। আগামী অর্থবছরের জন্য বাড়ছে ১০ পয়সা।
গতকাল সংসদে প্রধানমন্ত্রী তৈরি পোশাক রপ্তানিসহ বেশ কয়েকটি খাতে কর কমানোর প্রস্তাব করেন। পাসের আগে বিরোধী দলের কয়েকজন সাংসদ বিলটির ওপর জনমত যাচাই ও সংশোধনী প্রস্তাব দেন। তবে তাঁদের প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। গ্রহণ করা হয় সরকারি দলের হুইপ শহীদুজ্জামান সরকার ও শাহাব উদ্দিনের সংশোধনী প্রস্তাব।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে যেসব বিষয়ে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব দেন, তা নিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘রাজস্ব প্রস্তাব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কতিপয় পরামর্শ দিয়েছেন। আমার বাজেট প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের ওপরই রচিত এবং তাঁর পরামর্শ অবশ্যই নির্দেশ হিসেবে আমার কাছে গ্রহণযোগ্য।’
বাজেট নিয়ে অর্থনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও সংবাদপত্রের আলোচনা-সমালোচনা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে এবং এ বিষয়টিকে অনেক ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বলে মনে করেন মুহিত। তিনি বলেন, ‘অন্যদিকে বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন, রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। আমি এসব আলোচনা-সমালোচনাকে সব সময়ই স্বাগত জানাই।’গঠনমূলক সমালোচনা সরকারের কর্মকৌশলকে নির্ভুল করে উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘কিছু কিছু মন্তব্য এমন ঢালাওভাবে করা হয়েছে, যাতে আমি দুঃখ পাওয়ার চেয়ে বেশি বিস্মিত হয়েছি।’
মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় বেসরকারি বিনিয়োগ কিছুটা কমে যাওয়ার কথা স্বীকার করেও মুহিত আশা প্রকাশ করেন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ ৩ লাখ ৭৭ কোটি টাকা থেকে বেড়ে আগামী অর্থবছরে তা ৪ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হবে।
রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কমিশনার পর্যায়ের সবার সঙ্গে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘সাত বছরে তাঁদের জনবল ও দক্ষতা যেভাবে বেড়েছে, আমার স্থির বিশ্বাস যে তথাকথিত উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা তাঁরা অবশ্যই পূরণ করতে পারবেন।’রপ্তানি আয়ের উৎসে কর কমানো ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানের স্থান ও স্থাপনা ভাড়ার ওপর মূসক তুলে দেওয়ার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আরও পাঁচটি প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী।
এগুলো হচ্ছে শিল্প খাতের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে বর্তমানের ১ শতাংশ শুল্ক হার বজায় রাখার পাশাপাশি একই সুবিধা যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানিতেও সম্প্রসারণ করা, পাঁচ নিত্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক অব্যাহতি ও রেয়াতি সুবিধা আগামী অর্থবছরেও বজায় রাখা, শিশুপার্ক ও অ্যামিউজমেন্ট পার্ক নির্মাণের যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক রেয়াত অব্যাহত রাখা, ওষুধশিল্পের কিছু কাঁচামাল ও সরঞ্জামের কর সুষম করা এবং সিমকার্ড, স্মার্টকার্ড, সাইবার ব্যাংক, ফাইবার অপটিক কেব্ল তৈরির কাঁচামালের ওপর আরোপিত শুল্ক হার কমানো।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘জনগণের সার্বিক অংশগ্রহণ ছাড়া বাজেটের সার্থক বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। অতীতেও বাজেটকে উচ্চাভিলাষী আখ্যা দিয়ে বাস্তবায়ন সক্ষমতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। এসব সমালোচনা ও সংশয় ভ্রান্ত প্রমাণ করে আমরা এগিয়ে চলেছি স্বপ্নপূরণের পথযাত্রায়।’
আরও কিছু পরিবর্তন: করদাতাদের কর রেয়াতির সীমা প্রস্তাবিত ২০ শতাংশের পরিবর্তে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ এবং রেয়াতির হার আয়ভেদে ১০, ১২ ও ১৫ শতাংশ করা হবে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ই-কমার্সে কোনো মূসক আরোপ করা হবে না এবং জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও আমদানি শুল্ক থাকবে না।
অর্থমন্ত্রী বলেন, জুলাই-জুনকে সর্বজনীন আয়বছর করা হলেও বহুজাতিক কোম্পানির ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না। আর পরিবেশকদের লাভ যেখানে ঘোষিত হয় না, সেখানে লাভের অনুমিত কমিশন প্রস্তাবিত বাজেটে ১২ শতাংশ থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা ৬ শতাংশ করা হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, নির্মাণ খাতের বিভিন্ন উপকরণের ওপর শুল্ক কর কমানো হবে। রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল স্ট্রিপিং কেমিক্যালের আমদানি শুল্ক ২৫ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, স্পিনিং মিলের কাঁচামাল ফ্ল্যাক্স ফাইবার ও ডেনিমের কাঁচামাল স্পেনডেক্স/ইলাস্টোমেট্রিকের আমদানি শুল্ক ১০ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হবে।
এ ছাড়া এলকিড রেজিনের কাঁচামালের ওপর আমদানি শুল্ক ১০ থেকে বাড়িয়ে ১৫, মেডিকেল ও সার্জিক্যাল পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক ৫ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হবে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী বলেন, তামাকজাত পণ্য নিরুৎসাহিত করতে ৪৫ টাকা ও তার বেশি এবং ৭০ টাকা ও তার বেশি মূল্যস্তরের ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্কের হার গত অর্থবছরের চেয়ে ২ শতাংশ করে বাড়বে।
এ ছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে কিছু পণ্যের ট্যারিফ মূল্যেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে সিআর কয়েল থেকে রঙিন জিপি শিট/কয়েল প্রতি টনে ৭ হাজার টাকা এবং এইচআর কয়েল থেকে রঙিন জিপি শিট/কয়েলের ট্যারিফ প্রতি টনে ১৫ হাজার ৫০০ টাকা হবে।
এমএস প্রোডাক্টের মতো সিআর কয়েল বা এইচআর কয়েল থেকে সিআই শিট বা জিপি শিট বিপণনে প্রতি টনে ট্যারিফ হবে ১ হাজার ৩৩৩ দশমিক ৩৪ টাকা। দেশে উৎপাদিত প্রতিটি রিডিং গ্লাসের প্লাস্টিক ফ্রেমের ট্যারিফ ৪৫ টাকা এবং মেটাল ফ্রেমের ট্যারিফ ৫৫ টাকা হবে।
চা উৎপাদনে প্রণোদনা দিতে ট্যারিফ হবে প্রতি কেজি ১ দশমিক ৬ ডলার। প্রতি টন ইউরিয়া রেজিনের ট্যারিফ হবে ৯০০ ডলার এবং এর ওপর শুল্ক হার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হবে। ১ কেজি তাজা ফুলের ন্যূনতম ট্যারিফ ১ ডলার হবে। এ ছাড়া অবকাঠামোর জন্য প্রয়োজনীয় বোল্ডার স্টোন চিপসের শুল্ক করও কমানো হবে। অর্থবিল পাসের পর সংসদের অধিবেশন আজ বেলা দুইটা পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।