নারায়ণগঞ্জের বেনেটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। গত শনিবার হঠাৎ করেই কাজ বন্ধ করে দেন এ গ্রুপের তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। মে মাসের বেতন নির্ধারিত সময়ে না হওয়ায় এ পদক্ষেপ নেন তারা। একই দিন নারায়ণগঞ্জের আরেক কারখানা টাইম সোয়েটারের শ্রমিকরাও কাজ বন্ধ করে দেন। টাইম সোয়েটারে গতকাল কাজ হলেও বেনেটেক্সের শ্রমিকরা এদিনও কাজ বন্ধ রাখেন। দেশের তৈরি পোশাক শিল্প অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোয় প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। ঈদ ঘনিয়ে এলে এ ধরনের ঘটনা আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঈদে বেতন-বোনাস নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিতে পারে— এ ধরনের সাড়ে ৩০০ কারখানা শনাক্তও করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।
শিল্প পুলিশের হিসাবে, দেশে সব খাত মিলিয়ে শিল্প-কারখানা আছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার। এর অধিকাংশই পোশাক কারখানা। শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোর মধ্যে আছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, আশুলিয়া ও চট্টগ্রাম। পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট সংগঠন বিজিএমইএর হিসাবে পোশাক কারখানার সংখ্যা ৪ হাজার ২৯৬। সরকার পক্ষের দুটি পৃথক তালিকা অনুযায়ী, মোট ৩৫৮টি কারখানা আছে, যেগুলোয় বেতন-ভাতা নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষের ঝুঁকি রয়েছে। জানা গেছে, চলতি মাসেই পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএকে পৃথক দুটি তালিকা সরবরাহ করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে ১০৮টি কারখানার তালিকা। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে তালিকা করা হয়েছে ২৫০টি কারখানার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ তালিকাটি বিজিএমইএকে সরবরাহ করেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বণিক বার্তাকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে দুটি পৃথক তালিকা দেয়া হয়েছে সংগঠনকে। এগুলোসহ প্রায় ১ হাজার ২০০ কারখানা আমরা কঠোর নজরদারির মধ্যে রেখেছি। এ দুটি তালিকায় কিছু অভিন্ন কারখানাও থাকতে পারে। ঈদ সামনে রেখে আমরা গুরুত্বসহকারে তালিকাগুলো যাচাই-বাছাই করছি। সংশ্লিষ্ট কারখানা মালিকদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করার পরিকল্পনা রয়েছে। গত মাসে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে চলতি মাসের ২০ তারিখের মধ্যে শ্রমিকদের বোনাস পরিশোধে কারখানা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। চলতি মাসের বেতনও ঈদের আগেই দিতে বলা হয়। সমঝোতার ভিত্তিতে মূল মজুরির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বোনাস দেয়ার চেষ্টা করছেন মালিকরা। তবে ঈদের আগে অনেক মালিকই চলতি মাসের বেতন পরিশোধ করবেন না বলে আশঙ্কা শ্রমিক প্রতিনিধিদের।
১৭ জুন ১২টি শ্রমিক সংগঠনের জোট বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলন একটি প্রতিবাদ র্যালির আয়োজন করে। সেখানে তারা অভিযোগ করে, অনেক কারখানা মালিক আছেন, যারা জুনের বেতন কৌশলে এড়ানোর চেষ্টা করছেন। সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা এ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে যেকোনো সময় শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কা রয়েছে। আর অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তার জন্য মালিকরাই দায়ী থাকবেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মাহবুবুর রহমান ইসমাইল বলেন, বেতন-ভাতা নিয়ে বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে। তার পরও অনেক কারখানা আছে, যেগুলোর শ্রমিকরা বেতন-ভাতা যথাযথভাবে পাবেন কিনা সংশয় রয়েছে। আমাদের দাবি, ২০ রোজার মধ্যে বোনাস দিতে হবে। আর ঈদ উপলক্ষে কারখানা বন্ধ করে দেয়ার আগে পরিশোধ করতে হবে জুনের বেতন।
ঈদের আগে বেতন-বোনাস বিষয়ে কমপ্লায়েন্ট কারখানাগুলো নিয়ে খুব একটা উদ্বেগ নেই বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি। তিনি বলেন, নন-কমপ্লায়েন্ট কারখানা মালিকরা সুযোগ সন্ধানী। তারা অনেকেই বোনাস দেবেন শ্রমিকের সঙ্গে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে। অনেক মালিক আবার পূর্ণাঙ্গ বেতনও দেবেন না।শ্রমিক প্রতিনিধিদের কাছে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কা রয়েছে এমন কারখানার মধ্যে আছে কুড়িলের ডিসেন্ট অ্যাট ওয়্যার, জোয়ারসাহারার ক্লাসিক শার্টস, মিরপুরের বেঙ্গল লেদার ও লামিয়া ফ্যাশন এবং বিশ্বরোডের জেমস ডিজাইন। এছাড়া আশুলিয়ায় নাসা গ্রুপের দুটি কারখানায় বোনাস নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কা রয়েছে।
শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছরের মতো এবারো ঈদ সামনে রেখে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে শিল্প-কারখানাগুলো। আশুলিয়া, সাভার, ধামরাই এলাকার ১ হাজার ৩০টি কারখানার মধ্যে কিছু কারখানা আছে, যেগুলো বিশেষ নজরদারির মধ্যে রেখেছে শিল্প পুলিশ। এ ধরনের একটি কারখানা রাহাটেক্স। এছাড়া গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের রয়েছে ১ হাজার ৪০০ কারখানা। যদিও বড় ধরনের কোনো অসন্তোষ এখন পর্যন্ত সৃষ্টি হয়নি এ অঞ্চলের কারখানাগুলোয়। শিল্প পুলিশ নারায়ণগঞ্জের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও নরসিংদীতে পোশাক ও অন্যান্য খাত মিলিয়ে মোট ২ হাজার ৩০০ কারখানা কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে, এমন কারখানা রয়েছে ১৩১টি। শিল্প পুলিশের মহাপরিচালক আবদুস সালাম বলেন, শিল্পাঞ্চলের কারখানাগুলোর ওপর অন্যান্যবারের মতো এবারো কঠোর নজরদারি আছে। কতটি কারখানা নিয়ে আমাদের আশঙ্কা আছে, সে ব্যাপারে বিস্তারিত বলা যাবে আগামী বৃহস্পতিবার সব পক্ষের সঙ্গে বৈঠকের পর।