বাজেটে উচ্চ মাত্রায় রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও তা পূরণ না হওয়ায় আস্থাহীনতা বাড়ছে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। একই সঙ্গে প্রস্তাবিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নকে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছে তারা।
বিশ্বব্যাংকের মতে, রাজস্ব লক্ষ্য সব সময়ই বড় ধরা হয়, কিন্তু তা কখনও পূরণ না হওয়ায় বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে যায়। এটা ভালো লক্ষণ নয়। লক্ষ্য পূরণ না হওয়ার দুটি কারণ হচ্ছে, দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রায় গলদ থাকে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা না থাকায় রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা সঠিকভাবে ধরা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রায় গলদ মনে হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বুধবার বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এসব বিষয় তুলে ধরে সংস্থাটি।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিশ্বব্যাংক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন সংস্থার আবাসিক প্রধান চিমিয়াও ফান ও লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। বাজেটের ওপর সার্বিক বিশ্লেষণ তুলে ধরে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাজেটের আকার মোটেও ইস্যু নয়। দিন শেষে ইস্যু হচ্ছে ফলাফল। অর্থাৎ এর গুণগত ব্যয় কতটা হচ্ছে।
চিমিয়াও ফান বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি। এটি এখন স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধির জন্য বেশি বিনিয়োগ দরকার। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও অবকাঠামো উন্নয়নের বিকল্প নেই। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ব্যাপক বরাদ্দ থাকলেও বাস্তবায়ন কম, এটিও একটি চ্যালেঞ্জ। অভ্যন্তরীণ সম্পদ ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তাছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন জরুরি।
বিশ্বব্যাংকের মতামত তুলে ধরে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, রাজস্ব বাড়াতে বাজেটে বেশ কিছু সংস্কারের কথা বলা হলেও কোন সময়ে বাস্তবায়ন করা হবে তা বলা হয়নি। ব্যবসায়ীদের ওপর কর আরোপ, কোনো ক্ষেত্রে কর ছাড় এবং কিছু ক্ষেত্রে ন্যূনতম কর বৃদ্ধি ও অগ্রিম আয়কর নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে সরকারের আয় বাড়বে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেট বিনিয়োগ ও ব্যবসাবান্ধব নয়। বিশ্বব্যাংক মনে করে কর থেকে আদায়কৃত টাকা অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি, বিদ্যুৎ উৎপাদন-সঞ্চালন-বিতরণ অবকাঠামোর মান উন্নয়ন এবং অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে খরচ করা হলে বাজেট বিনিয়োগবান্ধব বলে মনে হবে। তখন যারা কর দেবেন তাদের বোঝা মনে হবে না। নতুন ভ্যাট আইনের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, বাজেটে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের জন্য কিছু প্রস্তুতি রয়েছে। ভ্যাট সংস্কারের কথা প্রতি বছরই বলা হলেও আসি আসি করেও সংস্কার আসে না। আগামী অর্থবছরে হয়তো এ সংস্কার আসবে।
এক প্রশ্নের জবাবে ড. জাহিদ বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা। বর্তমানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলেও অনিশ্চয়তা কাটেনি। তবে এটি বিনিয়োগে বাধা নয়, যদি বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টিতে অন্যান্য বিষয়গুলো ঠিক থাকে। উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, বাজেটে পরিবর্তনযোগ্য ব্যয়ের অংশ কমে যাচ্ছে। বাড়ছে অপরিবর্তনজনিত ব্যয়।
যেমন বেতন-ভাতা, ভর্তুকি ও সুদের বোঝা বাড়ছে। এগুলো ব্যয় কমানোর সুযোগ নেই। সুদের বোঝা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে সঞ্চয়পত্রের সুদের কারণে এটি হচ্ছে। এজন্য সুদের হার সংস্কারের সময় এসেছে। সুদহার নীতিমালা সংস্কার করতে হবে। বাজেট ঘাটতি পূরণে ২২ বিলিয়ন ডলারের বেশি পাইপলাইনের অর্থ ব্যয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সুযোগ কাজে লাগানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে কাজ সৃষ্টি করতে হবে। ফলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সেটি হতে হবে শ্রমঘন শিল্পে। বাজেটে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু বলা হয়নি।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, বছরের শুরুতে নতুন প্রকল্প কম থাকলেও পরবর্তীকালে তা বেড়ে যায়। এডিপির যে আকার ধরা হয়েছে তা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এডিপি বাস্তবায়ন দেরি হয় কারণ শুরু থেকেই প্রস্তুতি থাকে না। ১ জন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগসহ বেশ কিছু সংস্কারের উদ্যোগ আছে। কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পে বরাদ্দের পর্যাপ্ততা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বর্তমানে যে হারে বরাদ্দ ধরা হয়েছে সেটি অব্যাহত রাখলে সঠিক সময় এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে না। প্রয়োজনমতো বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন। বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রাইসিং পলিসি সংস্কার প্রয়োজন। এ খাতে ভর্তুকি দারিদ্র্যবান্ধব করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ।
ড. জাহিদ বলেন, রাজস্ব আয় এবং এডিপিতে প্রকল্প বাস্তবায়নে উচ্চাকাক্সক্ষা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা অন্য বছরের বাজেটের মতোই খুব বেশি পরিবর্তন নেই। বাজেট শুধু আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়, মধ্যমেয়াদি সংস্কারও থাকে। কিন্তু আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কৌশলগত পদক্ষেপ থাকলেও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের নির্দেশনা নেই।
বাজেট প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়েছে, বর্তমানে অর্থনীতিতে মিশ্র অবস্থা বিরাজ করছে। একদিকে ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবাহ ও রাজস্ব আয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবস্থা গত অর্থবছরের তুলনায় ভালো হচ্ছে। অন্যদিকে শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও নির্মাণ সামগ্রীর আমদানি এবং রেমিটেন্স প্রবাহ গত অর্থবছরের তুলনায় কম।