আশুগঞ্জ নৌবন্দরে গতকাল এমভি নিউটেক-৬ জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের মধ্য দিয়ে কলকাতা-আশুগঞ্জ-আখাউড়া-আগরতলা পথে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক ট্রানজিট শুরু হয়েছে l বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে কলকাতা থেকে আগরতলায় এক হাজার টন স্টিল শিট বা ইস্পাতের পাত নিচ্ছে ভারত। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে আশুগঞ্জ নৌবন্দরে জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানোর মধ্য দিয়ে নিয়মিত ট্রানজিটের আনুষ্ঠানিক যাত্রার উদ্বোধন করা হয়। ট্রানজিটের প্রথম চালানে আগরতলার ডারসেল লজিস্টিক নামের একটি প্রতিষ্ঠান ১ হাজার টন স্টিল শিট নিচ্ছে। ভারতের টাটা স্টিল কোম্পানির কাছ থেকে তা কেনা হয়েছে। এ চালানটি কলকাতা থেকে আশুগঞ্জ বন্দর পর্যন্ত নৌপথে এসেছে। এখন আশুগঞ্জ থেকে সড়কপথে আখাউড়া হয়ে আগরতলায় নেওয়া হবে। প্রতি টনের জন্য ১৯২ টাকা মাশুল আদায় করা হয়েছে। পুরো পথের পরিবহনের ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে আনবিস ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নামের বাংলাদেশি একটি প্রতিষ্ঠান। আগামীকাল শনিবার কিংবা পরদিন রোববার আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে আগরতলায় পণ্য নেওয়া শুরু হতে পারে। গতকাল আশুগঞ্জ নৌবন্দর ঘাটে জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানো বা ট্রান্সশিপমেন্ট কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান নৌ-প্রটোকলের আওতায় এ ট্রানজিট শুরু হয়েছে। আগে নৌ-প্রটোকলের আওতায় কলকাতা থেকে আগরতলায় পণ্য নেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। তবে এ পথে পণ্য নিতে ভারত আগ্রহ প্রকাশ করলে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে পরীক্ষামূলক তিনটি চালান নেওয়া হয়। আর এখন ভারতের তাগিদে পাঁচ বছর পর মাশুল আরোপ করে কলকাতা-আশুগঞ্জ-আখাউড়া-আগরতলা পথে নিয়মিত ট্রানজিট শুরু করা হলো। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এ ট্রানজিটের যাবতীয় বিষয় দেখাশোনা করবে। কলকাতা টু আগরতলা: গত ১৫ মে ১ হাজার টন স্টিল শিট পরিবহনের জন্য আনবিস ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডকে অনুমতি দেয় বিআইডব্লিউটিএ। আনবিসের জাহাজ এমভি নিউটেক-৬ স্টিল শিট নিয়ে গত ৩ জুন কলকাতার খিদিরপুর বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে। তিন দিন পর ৬ জুন ভারতীয় সুন্দরবন এলাকার হেমনগর নৌসীমান্তে¯ পৌঁছে। সেখানকার আনুষ্ঠানিকতা শেষে ৭ জুন বাংলাদেশের নৌসীমান্ত¯ সুন্দরবন অঞ্চলের আংটিহারায় নোঙর করে এমভি নিউটেক। শুল্ক কর্তৃপক্ষের মাশুল পরিশোধের জন্য জাহাজটিকে চার দিন আংটিহারায় বসে থাকতে হয়। সেখানে মাশুল পরিশোধের সুবিধা নেই; শুল্ক কর্মকর্তারা শুধু পণ্যগুলো সিলগালা করেন। জাহাজের তত্ত্বাবধায়ক রিপন শেখ আংটিহারা থেকে খুলনায় এসে শুল্ক বিভাগের মাশুল পরিশোধ করেন। এসব করতে সময় লাগে মোট চার দিন। এরপর ১১ জুন আংটিহারা থেকে রওনা দিয়ে বরিশাল, চাঁদপুর, দাউদকান্দি মেঘনা ঘাট হয়ে ১৪ জুন বিকেল চারটার দিকে আশুগঞ্জ পৌঁছে। এ বিষয়ে জাহাজের তত্ত্বাবধায়ক রিপন শেখ প্রথম আলোকে বলেন, আংটিহারায় মাশুল পরিশোধের সুযোগ থাকলে আট দিনেই কলকাতা থেকে আশুগঞ্জ পৌঁছানো সম্ভব হতো। এখন রাতে পণ্যবাহী জাহাজ চলতে পারে না। রাতে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের সুবিধা তৈরি করা হলে চার-পাঁচ দিনেই কলকাতা থেকে আশুগঞ্জ আসা সম্ভব। এখন আশুগঞ্জ নৌবন্দরে জাহাজ থেকে পণ্য ট্রাকে ওঠানো হবে; পরে সড়কপথে আখাউড়া স্থলবন্দরে নেওয়া হবে। ট্রাকে ওঠানোর পরপরই শুল্ক কর্মকর্তারা তা আবার সিলগালা করবেন। এরপর আখাউড়া-আগরতলা সীমান্তের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে এ চালানের ট্রানজিট প্রক্রিয়া শেষ হবে। জানা গেছে, আশুগঞ্জ থেকে আগরতলায় পণ্য নিতে সাত থেকে দশ দিন লাগবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান: আশুগঞ্জ নৌবন্দরের গুদামঘরে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, আপাতত টনপ্রতি ১৯২ টাকা মাশুল নেওয়া হচ্ছে। স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাসহ (অটোমেশন) অন্য আধুনিক সুবিধা চালু হলে মাশুলের পরিমাণ বেড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা হতে পারে। মন্ত্রী বলেন, অচিরেই আশুগঞ্জ কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের পাশাপাশি আশুগঞ্জ-আখাউড়া সড়কটি চার লেনে উন্নীত করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান তাঁর বক্তৃতায় বলেন, বাণিজ্য বাড়াতে হলে যাতায়াতব্যবস্থা সুগম করতে হবে। বাংলাদেশ সরকারই নির্ধারণ করবে কোথায় কী ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করবে। শুধু ভারত নয়, পার্শ্ববর্তী নেপাল ও ভুটানের সঙ্গেও বাণিজ্যনির্ভর সহযোগিতা বৃদ্ধি করা হবে। ভারতীয় হাইকশিনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেন, দুই দেশের অকৃত্রিম বন্ধুত্বের অংশ হিসেবে আজকের দিনটি ঐতিহাসিক। দীর্ঘদিন আলোচনার পর প্রথমবারের মতো বহুমাত্রিক ট্রানজিট ব্যবস্থার আওতায় বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের একটি অংশ থেকে আরেক অংশে পণ্য যাচ্ছে। ট্রানজিট চালু হওয়ার পর ত্রিপুরার মানুষের জীবনযাত্রা আরও সহজ হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বলেন, ট্রানজিটের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ে নতুন ক্ষেত্র তৈরি হলো। যে মাশুল নির্ধারণ করা হয়েছে, তা হয়তো সামান্য। কিন্তু ট্রানজিট প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মসংস্থান তৈরি হবে। অনুষ্ঠানের সভাপতি নৌসচিব অশোক মাধব রায় বলেন, শিগগিরই আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরু হবে। আর নৌ-প্রটোকলের আওতায় পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশি জাহাজ কোম্পানিই বেশি কাজ পাবে। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্থানীয় সাংসদ র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, সাংসদ জিয়াউল হক মৃধা, বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর এম মোজাম্মেল হক, বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল মালিক সমিতির সভাপতি মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক মোশাররফ হোসেন, পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান প্রমুখ।