ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত উদ্বেগে ফেলেছে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের। বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানি বাজার যুক্তরাজ্য। সেখানে বছরে প্রায় ৩২০ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ; যার মধ্যে সিংহভাগই তৈরি পোশাক।
এ ছাড়া ইইউতে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধাসহ রপ্তানির ক্ষেত্রে যেসব সুবিধা পাওয়া যেত, এখন যুক্তরাজ্যের বাজারে তা পাওয়া যাবে কি না, এ নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ইইউ থেকে যুক্তরাজ্য বেরিয়ে গেলে তাদের সঙ্গে নতুন করে বাণিজ্যসংক্রান্ত সব চুক্তি করতে হবে। রপ্তানিতে ইইউতে বর্তমানে বাংলাদেশ অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা (জিএসপি) পেয়ে থাকে। যুক্তরাজ্যের বাজারে এখন আলাদা করে এ সুবিধা পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
অর্থনীতিবিদ ও রপ্তানিকারকেরা বলছেন, যুক্তরাজ্যের এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে তখন বাংলাদেশের রপ্তানির জন্য এটিকে একক দেশ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। ইইউতে প্রাপ্ত সুবিধাগুলো আদায় করতে নতুন করে তাদের সঙ্গে দেনদরবার করতে হবে।
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের মতে, ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাউন্ড ও ইউরোর দাম পড়ে গেছে। পাউন্ড ও ইউরোর মুদ্রামান যদি আরও কমে যায়, তাহলে তার ধাক্কা এসে লাগবে এ দেশের রপ্তানিপণ্যের দামের ওপরও।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ‘যুক্তরাজ্যের এ সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের ওপর স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি নানা প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে। একদিকে যুক্তরাজ্য যেমন আমাদের বড় রপ্তানিবাজার, ঠিক তেমনি প্রবাসী অনেক বাংলাদেশিও দেশটিতে রয়েছেন। ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কারণে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হলে তার প্রভাব নানাভাবে বাংলাদেশেও পড়বে।’
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এর ফলে আবারও বিশ্ব অর্থনীতির জন্য একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হলো। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই অস্থিরতা আরও কিছুদিন চলবে। সেটি হলে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে কিছুটা ধীরগতি দেখা দিতে পারে। তাতে দেশটিতে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থান ও আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর ফলে কমে যেতে পারে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়।
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, রপ্তানিবাজারের পাশাপাশি যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের কাছে একটি বড় সাহায্যকারী দেশও। যদি দেশটির অর্থনীতি মন্দার কবলে পড়ে, তখন স্বাভাবিকভাবে সাহায্যের পরিমাণও কমে যাবে।
জানা গেছে, ব্রিটিশ সাহায্য সংস্থা ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি) এখন গড়ে প্রতিবছর প্রায় ২৫ কোটি পাউন্ড ঋণ সাহায্য দিয়ে থাকে।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি ফারুক হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর তাৎক্ষণিকভাবে দামের চাপ তৈরি হবে। কারণ, ইতিমধ্যে পাউন্ড ও ইউরোর মানের অবমূল্যায়ন শুরু হয়েছে। সেটি অব্যাহত থাকলে আমরা পোশাক রপ্তানি করে আগের চেয়ে কম দাম পাব। সাধারণত বিদেশি ক্রেতারা অজুহাত পেলেই দাম নিয়ে দেনদরবার শুরু করেন। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা দেখা দিলে সেখানে পণ্যের চাহিদাও কমে যেতে পারে। সেদিক থেকেও আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। সব শেষে ইইউতে রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত যেসব সুবিধা ছিল, সেগুলো নতুন করে করতে হবে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে।’
ফারুক হাসান আরও বলেন, ‘ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের ফলে বিশ্ববাজারে কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তা আমরা বুঝতে পারব আগামী সোমবার।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, যখনই একটি দেশে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, তা বিনিয়োগকে প্রভাবিত করে। বিনিয়োগ কমে গেলে চাহিদাও কমে যাবে। এর ফলে পণ্যের রপ্তানি কমে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি ইইউভুক্ত দেশগুলোর ওপরও এখন আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হবে। ফলে সেখানে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া ইইউতে প্রাপ্ত সুবিধাগুলো যুক্তরাজ্যে পাওয়া যাবে কি না, সেটিও বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের জন্য নতুন উদ্বেগের বিষয়।
এদিকে, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার খবরে গত শুক্রবার পাউন্ডের দাম ৮ শতাংশ কমে গেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বা অবমূল্যায়িত হয়ে একটি পর্যায়ে স্থিতিশীল হয়ে গেলে তাতেও বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানিমূল্য কমে যাওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন রপ্তানিকারকেরা। যদিও বাংলাদেশের রপ্তানির সিংহভাগই মার্কিন ডলারের হিসাবে হয় বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএর নেতা ফারুক হাসান। তিনি বলেন, ডলারে রপ্তানি হিসাব হলেও ইউরোপের বেলায় ক্রেতারা তা স্থানীয় মুদ্রায় স্থানান্তর করে হিসাব করে থাকেন। তিনি বলেন, সর্বশেষ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যের বাজারে ৩২০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ, যার মধ্যে ৩০০ কোটি ডলারই আসে পোশাক রপ্তানি থেকে।