গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর গত তিন সপ্তাহে অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে দেশের রফতানি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস গার্মেন্ট খাত ভয়াবহ খারাপ অবস্থায় মোড় নিয়েছে। এ ঘটনায় আতংকের অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশে আসতে চাচ্ছে না বিদেশী ক্রেতারা (বায়ার)। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে তাদের ক্রয় আদেশ (অর্ডার) বাতিল করেছে। যারা এখনও বাতিল করেনি, তারাও আলোচনার জন্য অথবা নতুন অর্ডার দিতে বাংলাদেশে আসতে চান না। সংশ্লিষ্ট গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের ভারত, সিঙ্গাপুর এবং ব্যাংককে যেতে বলছে। ভুক্তভোগীদের অনেকে মনে করেন, এটি দেশের বিরুদ্ধে মহল বিশেষের বড় ধরনের ষড়যন্ত্র। তারা মূলত দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ গার্মেন্ট খাতের বাজারকে ভারতের হাতে তুলে দিতে চায়।
এছাড়া সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ দুটি সন্ত্রাসী হামলার পর শুধু গার্মেন্ট খাত নয়, নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পুরো অর্থনীতিজুড়ে। শিল্পে বিনিয়োগসহ দেশের অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য খাত পর্যটন, পরিবহন, হোটেল-রেস্তোরাঁর ব্যবসা, শপিংমল, বিপণি বিতান এবং বিনোদন কেন্দ্রগুলোতেও বেহাল অবস্থা বিরাজ করছে। সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) কমে যাচ্ছে। কমে গেছে বিদেশ থেকে আসা বিমানের যাত্রীর সংখ্যাও। অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহল আশংকা করছেন জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে এভাবে বদনাম ছড়ালে জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়তে পারে। জনশক্তি নেয়ার ক্ষেত্রে বিদেশীরা আরও সতর্ক হবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এমন একসময় এ হামলা হল, যখন বায়ারদের অর্ডার দেয়ার মৌসুম। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে খুব অল্পদিনেই জঙ্গি হামলার নেতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতিতে চরম দুর্গতি নেমে আসবে। দীর্ঘমেয়াদে তা মহামারী আকার ধারণ করবে। তারা মনে করেন, এ ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, তা যেমন যথেষ্ট নয় এবং অনেকটা লোক দেখানো।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য অংশই কোনো না কোনোভাবে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর অর্থনীতির বড় শত্র“ হল আতংক, ভীতি এবং অনিশ্চয়তা। পরপর দুই দফা জঙ্গি হামলার মধ্য দিয়ে বড় ধরনের ভীতি তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, যেসব ইতালিয়ান নাগরিক মারা গেছেন, তারা সবাই গার্মেন্ট খাতে কাজ করতেন। আর যেসব জাপানি নাগরিক মারা গেছেন, তারা মেট্রোরেলের মতো উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করতেন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বিশ্বে প্রমাণ হয়েছে, বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য হল বিদেশীরা। তিনি বলেন, এজন্য বিভিন্ন দূতাবাসে সতর্কতা জারি হয়েছে। বলা হচ্ছে, খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলে বাংলাদেশে যাওয়া উচিত না। তিনি আরও বলেন, আমরা শুনেছি বিভিন্ন দেশের ক্রেতারা অর্ডার দিতে বাংলাদেশে আসতে ভয় পাচ্ছেন। তারা গার্মেন্ট মালিকদের বলছেন, তোমরা দিল্লি বা সিঙ্গাপুরে আসো। অর্থাৎ ক্রেতাদের মধ্যে একটি আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এটি কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে, তা নির্ভর করবে কীভাবে এই হামলা মোকাবেলা করা হচ্ছে, তার ওপর।
সূত্র বলছে, দেশের গার্মেন্ট পণ্যের অন্যতম ক্রেতা ইউরোপের প্রভাবশালী দেশ ইতালি। আর হামলায় দেশটির বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর নিহত হওয়ার পর ইতালির বাজার হাতছাড়া হতে চলেছে। সূত্রের দাবি, দেশের কর্মসংস্থানেরও সবচেয়ে বড় খাতটি একটি চক্রান্তের মধ্যে পড়েছে। প্রতিবেশী একটি দেশে যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্ডার। এদিকে সম্প্রতি বিজনেস টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার পর তিন হাজার কোটি ডলারের পোশাক খাত হুমকির মুখে। গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সূত্র জানায়, সম্প্রতি কানাডার ব্র্যান্ড সিয়ার্সের একটি প্রতিনিধি দলের থাইল্যান্ড, ভারত ও বাংলাদেশ সফরের কথা ছিল। কিন্তু সিয়ার্স বাংলাদেশ সফর বাতিল করে সংশ্লিষ্ট রফতানিকারককে ভারত বা থাইল্যান্ডে যেতে বলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্র্যান্ড অ্যারো পোস্টালও একই কারণ দেখিয়ে সফর বাতিল করে তৃতীয় কোনো দেশে বৈঠকের কথা বলেছে। ১৮ জুলাই ইউএস কটন কাউন্সিলের ঢাকায় একটি পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিল হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বরে ঢাকায় বিপুলসংখ্যক দেশী-বিদেশীর অংশগ্রহণে বড় আকারে প্রদর্শনীর উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশের অন্যতম বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এইচ অ্যান্ড এম। সম্প্রতি ওই অনুষ্ঠানও স্থগিত করা হয়েছে। কমে গেছে বিদেশ থেকে আসা বিমানের যাত্রীসংখ্যাও। জানা গেছে, শুক্রবার লন্ডন থেকে ৪১৯ আসনের একটি বিমান মাত্র ৬২ জন যাত্রী নিয়ে ঢাকায় আসে। অথচ স্বাভাবিক সময়ে বিমানটির যাত্রীসংখ্যা ৪১০ জনের নিচে নামত না।
বিদ্যমান পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে হামিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি একে আজাদ যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে কোনো বায়ার প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আসছে না। যারা এ দেশে অবস্থান করছে তারাও খুব একটা নড়াচড়া করছে না। ফলে বায়ারদের শতভাগ অর্ডার নেগোসিয়েশনের জন্য এখন তৃতীয় কোনো দেশে ধরনা দিতে হচ্ছে। ক্রেতা ধরে রাখতে প্রতি সপ্তাহেই যেতে হচ্ছে দেশের বাইরে। সামান্য পরামর্শের ভেনু্যুও নির্ধারণ হচ্ছে বায়ারদের ইচ্ছার ওপর। তার মতে, এতে ব্যবসার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সে অনুযায়ী পোশাকের মূল্য বাড়ছে না। তিনি বলেন, এরপরও ব্যবসায়ীরা মুনাফার চিন্তা করছেন না। দুশ্চিন্তা হল ক্রেতা যাতে তাদের অর্ডার বাতিল না করেন। তারা যাতে বাংলাদেশ ছেড়ে প্রতিযোগী কোনো দেশে না যায়। এ পরিস্থিতিতে গার্মেন্ট শিল্পসহ সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যে একটা নীরব স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এ অচলাবস্থা দূর করতে যত দ্রুত সম্ভব দেশের মানুষ কিংবা ক্রেতাদের জঙ্গি হামলার আতংক দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি। সম্প্রতি বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়েছে, জঙ্গি হামলার কারণে আগামী মৌসুমে দুই থেকে আড়াইশ’ কোটি ডলার মূল্যের পোশাক রফতানি বাজার হারাতে পারে বাংলাদেশ। তারা বলেছে, পশ্চিমা দেশের ক্রেতারা জুলাই-আগস্টের গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে মোট পোশাক অর্ডারের ৬০ শতাংশের অর্ডার দিয়ে থাকে। এখন ক্রেতারা অর্ডার দিয়ে গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে চলে যাবেন। অর্ডার নেয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।
জানা গেছে, জঙ্গি হামলার পর গার্মেন্ট খাতের পরে প্রভাব পড়েছে দেশের পর্যটন খাতে। প্রতি মাসে স্লোভাকিয়া থেকে একটি ভ্রমণকারী দল দেশের উত্তরবঙ্গে আসে। তাদের আনা-নেয়ার কাজ করে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস। প্রতিষ্ঠানটির সিইও মিন্টু রত্ন যুগান্তরকে বলেন, জঙ্গি হামলার পর বাংলাদেশ সফর অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে ওই দলটি। তিনি বলেন, স্লোভাকিয়ার মতো যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি, ইউরোপ ও ইতালিসহ বিশ্বের অনেক দেশের ভ্রমণপিপাসুরা বাংলাদেশের সফর বাতিল করেছে। আর ভ্রমণের জন্য বেছে নিচ্ছে ভারত, মালদ্বীপ ও নেপালকে। পাশাপাশি কমেছে দেশী পর্যটকদের ভ্রমণও। দ্য সাউদার্ন ট্যুরসের মিজানুর রহমান মিজানের মতে, গত বছর ঈদে প্রায় আড়াইশ’জন বিদেশী পর্যটক সুন্দরবন দেখতে আসে। এ বছর এসেছে মাত্র আটজন। তার মতে, নিরাপত্তার কারণে পর্যটকরা আসছে না। ফলে পর্যটন শিল্প ঘিরে গড়ে ওঠা হোটেল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মন্দা চলছে। অলস পড়ে আছে পর্যটন কেন্দ্রের লঞ্চ, ট্রলার, বোট। সুন্দরবন লাইভ ট্যুরসের গোলাম রহমান বিটু বলেন, ঈদের ছুটিতে সাতজন জার্মানসহ মোট ১৩ জন বিদেশীর সুন্দরবনে আসার বুকিং ছিল। কিন্তু গুলশানে হামলার কারণে সেসব বিদেশী বুকিং বাতিল করেছেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, জঙ্গি হামলার পর মানুষের মধ্যে কিছু ভীতি কাজ করছে। তবে তারা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টাও করছে। তিনি বলেন, স্বল্পমেয়াদে এই ঘটনার প্রভাব এখনও ওইভাবে দৃশ্যমান হয়নি। তবে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়বে। নতুন করে বিনিয়োগ করার ব্যাপারে হয়তো বিদেশীরা চিন্তা করবে। কারণ নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত না হলে কেউ বিনিয়োগে আসবে না। এক্ষেত্রে সরকার কী পদক্ষেপ নেয়, সেটি বিবেচনার বিষয়। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তখন বিনিয়োগের পথ সংকুচিত হবে। নতুন বিনিয়োগ না এলে সরকার কাক্সিক্ষত মাত্রায় প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে না।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর প্রথম সহ-সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, বিভিন্ন কারণে এমনিতেই অর্থনীতিতে মন্দা যাচ্ছে। এ সময় দেশের ভেতরে জঙ্গি হামলা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। মন্দা চলছে দেশের পাঁচ তারকা হোটেল ও অভিজাত রেস্তোরাঁগুলোর ব্যবসায়। গুলশানের পাঁচ তারকামানের হোটেল ওয়েস্টিনের বুকিং অর্ডার নেমে এসেছে মাত্র ১২ শতাংশে। স্বাভাবিক সময়ে এর হার ছিল ৮০ শতাংশের ওপরে। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলের বুকিং ২০ শতাংশ কমেছে। জানতে চাইলে সোনারগাঁও হোটেলের জনসংযোগ কর্মকর্তা সালমান কবির যুগান্তরকে বলেন, হোটেল ব্যবসার প্রাণ হচ্ছে বিদেশীরা। কিন্তু জঙ্গি হামলা ইস্যুতে বিভিন্ন দেশের অতিথিরা বাংলাদেশে আসা কমিয়ে দিয়েছেন। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বুকিং রেটে।
অন্যদিকে গেস্ট হাউসগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, শুধু গুলশান, বারিধারা ও বনানী এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে ৭০টি গেস্ট হাউস রয়েছে। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মিলিয়ে ১৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান। কিন্তু বর্তমানে এখানে চরম মন্দা চলছে। জানতে চাইলে হোটেল অ্যান্ড গেস্ট হাউস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফ আহমেদ বলেন, গুলশানে হামলার পর নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দিয়েছে। গুলশানের বেঙ্গল ইনের নির্বাহী পরিচালক আবদুল আজিজ বলেন, সাধারণত সেপ্টেম্বর-মার্চ পর্যন্ত বিদেশী পর্যটকরা বেশি আসেন। গেস্ট হাউসগুলোতে বুকিং দেন। কিন্তু হামলার ঘটনার পর আগাম বুকিং সব বাতিল হয়ে গেছে। এমনকি অবস্থানরত বিদেশীরাও পরদিন হোটেল ছেড়ে চলে গেছেন।