Home বাংলা নিউজ বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ব্যবসা নিয়ে শঙ্কা কাটছে

বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ব্যবসা নিয়ে শঙ্কা কাটছে

rmg

.গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় ১ জুলাইয়ের জঙ্গি হামলায় বায়িং হাউস স্টুডিও টেক্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাদিয়া বেনেদিত্তি নিহত হন। ইতালীয় এই নাগরিকের মালিকানায় গাজীপুরে একটি সোয়েটার কারখানা আছে। প্রতিষ্ঠান দুটির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা থাকলেও গত রোববার নাদিয়ার ভাই পাউলো বেনেদিত্তি তৈরি পোশাক-শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর একাধিক নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন। পাউলো তাঁর বোন নাদিয়ার অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশে তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা না গোটানোর কথা বিজিএমইএর নেতাদের জানিয়েছেন। তবে নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিক একজন গানম্যান চেয়েছেন তিনি। বিষয়টি নিশ্চিত করে বিজিএমইএর সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, নাদিয়ার ভাইয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সহায়তা করবে তাঁদের সংগঠন।

এ রকম বেশ কয়েকটি ইতিবাচক ঘটনার কারণে সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার পর নিরাপত্তার অজুহাতে ব্যবসা চলে যাবে কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এমনটা বিশ্বাস করেন না পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। তবে গুলশান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে বিদেশি ক্রেতারা একের পর এক বাংলাদেশ ভ্রমণ স্থগিত করেছেন এবং করছেন। ক্রয়াদেশ দিতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করতে তৃতীয় দেশে ডেকে পাঠাচ্ছেন ক্রেতারা। এতে করে ক্রয়াদেশ পাওয়ার বিষয়ে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের দৌড়ঝাঁপ ও খরচ বেড়েছে। সব মিলিয়ে সামনের বসন্ত (স্প্রিং) ও গ্রীষ্ম (সামার) মৌসুমে পোশাকের ক্রয়াদেশ কিছুটা কমতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। গত কয়েক দিনে পোশাকশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৭ জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা প্রায় সবাই বলেছেন, জঙ্গিবাদ এখন আর কোনো একক দেশের সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক সমস্যা। ফলে সাময়িকভাবে কিছুটা জটিলতা তৈরি হলেও দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বাংলাদেশ। তবে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বর্তমানে যে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, সেটি ধরে রাখতে হবে। গুলশানের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

ভ্রমণ স্থগিত, ভিসা জটিলতা: জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ইসলাম গার্মেন্টসের পূর্বনির্ধারিত সাতটি বৈঠক স্থগিত হয়েছে। বিভিন্ন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের বাংলাদেশে এসে এসব বৈঠক করার কথা ছিল। নিরাপত্তার কারণে বৈঠকগুলো হবে ডেনমার্ক, যুক্তরাষ্ট্র, হংকং ও ভারতে। ইসলাম গার্মেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার হয়তো ভিসা আছে। তবে সব বৈঠকে তো আমি যেতে পারব না। আমার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে ভিসা জটিলতায় পড়তে হবে। আবার হংকংয়ের ভিসা পাওয়া খুব সমস্যা।’ ভিসা জটিলতার কথা জানালেন আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী। তাঁদের মধ্যে বিকেএমইএর সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গুলশানে জঙ্গি হামলার পর তাৎক্ষণিক সমস্যা হচ্ছে, ক্রেতারা বাংলাদেশ ভ্রমণ স্থগিত করছেন। এ জন্য পোশাকের ক্রয়াদেশ পাওয়ার প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত হবে। তিনি বলেন, ক্রেতারা তৃতীয় দেশে বৈঠক করতে বলছেন। তাতে অনেকেই ভিসা জটিলতায় পড়ছেন। এ ছাড়া নানা কারণে কিছু ব্যবসায়ীর পক্ষে বিদেশে গিয়ে বৈঠক করা সম্ভব নয়। ফলে ক্রয়াদেশে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও পড়তে পারে।

বিষয়টি স্বীকার করে বিজিএমইএর সহসভাপতি (অর্থ) মোহাম্মদ নাছির বলেন, ‘হংকং ভিসা এখন ব্যবসায়ীদের গলার ফাঁস হয়ে গেছে। ভিসা নিতে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগছে। সব ক্রেতা তো এত দিন সময় দেবেন না। বিষয়টি নিয়ে আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তবে এখনো সমাধানে পৌঁছানো যায়নি।’ অবশ্য সব ক্রেতাই যে বাংলাদেশ ভ্রমণ বাতিল করছেন তা নয়। নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ও প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক গতকাল বুধবার জানালেন, জার্মানির একজন ক্রেতা ১৮ জুলাই বাংলাদেশে এসে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করে গেছেন। তৃতীয় দেশে বৈঠকের অভিজ্ঞতা: ঈদের পর ক্রয়াদেশ দিতে বাংলাদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করতে আসার কথা ছিল ইংল্যান্ডের খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান পিককের প্রতিনিধিদের। তবে গুলশান হামলার পর বৈঠকটি তাঁরা ভারতে করতে চান। তাই বাধ্য হয়েই দেশের ব্যবসায়ীদের সেখানে যেতে হয়।

ভারতে পিককের সঙ্গে গত সপ্তাহে বৈঠক করে আসা স্পাইডার গ্রুপের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম এমনটাই জানালেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গুলশানের হামলায় বিদেশিদের টার্গেট করে মেরেছে জঙ্গিরা। আগেও এ ধরনের কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। সে জন্যই প্রতিক্রিয়াটি বেশি হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ব্যবসা কমবে আমরা এমনটা আমি মনে করছি না। তবে ক্রেতারা আসতে কিছুটা ভয় পাচ্ছে। সাময়িক এ সমস্যা দূর হয়ে যাবে, যদি ভবিষ্যতে এ ধরনের হামলা আর না হয়।’ ক্রেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতে সম্প্রতি জার্মানি ও হংকং গিয়েছিলেন ফজলুল হক। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে ঈদের পর ছয়জন ক্রেতার সঙ্গে আমার বৈঠক হয়েছে। তবে কেউ নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানাননি।’ তিনি আরও বলেন, ‘গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলার পর যেটি হয়েছে, ক্রেতারা দেশে আসতে একটু ভয় পাচ্ছে। তবে এর সঙ্গে ব্যবসা দেওয়া না দেওয়া কিংবা পোশাকের দাম কম দেওয়ার কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই। তবে ক্রেতারা দেশে না আসায় ব্যবসায়ীদের দৌড়াদৌড়ি বেড়েছে।’

ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তা কাটছে: বিদায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছর ২ হাজার ৮০৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছর পোশাক রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৩৭ কোটি ডলার। এর মধ্যে ইতালিতে ১২৮ কোটি ও জাপানে ৭৭ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। গুলশানের জঙ্গি হামলার পর নয়জন ইতালীয় নাগরিক ও সাতজন জাপানি নাগরিক নিহত হন। ঘটনার পরপরই জাপানের বড় ব্র্যান্ড ইউনিক্লো বাংলাদেশে অবস্থানরত তাদের কর্মকর্তাদের ভ্রমণ না করে বাড়িতে নিরাপদে অবস্থান করতে বলে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। সব মিলিয়ে পোশাকশিল্প মালিকদের কেউ কেউ জাপান ও ইতালির বাজারে পোশাক রপ্তানি হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তবে সেটি কাটতে শুরু করেছে। বব উইন কো নামের জাপানি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সাতজনের একটি প্রতিনিধিদল এক সপ্তাহের জন্য ২২ জুলাই বাংলাদেশে আসার কথা ছিল। তবে জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের বাংলাদেশ ভ্রমণের অনুমতি দেয়নি। দেশের কয়েকটি তৈরি পোশাক কারখানা পরিদর্শন করে ক্রয়াদেশ দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাঁদের। ১৬ জুলাই বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশনের আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেছিলেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম। গত রোববার তিনি জানান, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটির চীনে একটি কার্যালয় আছে। সেখান থেকে দুজন শিগগিরই বাংলাদেশে আসবেন।

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার ঘটনায় অন্যদের সঙ্গে ইতালির স্টার ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান ক্লাইদিয় কাপেল্লি নিহত হন। আশুলিয়ার রক নিটওয়্যারসহ কয়েকটি কারখানায় তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতকৃত পোশাক পরিদর্শন করতে গত মাসে বাংলাদেশে এসেছিলেন। রক নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামসুল হক ক্ষতির আশঙ্কায় ছিলেন। কারণ, ক্রয়াদেশ অনুযায়ী প্রস্তুতকৃত ৫৭ হাজার ডলারের পলো টি-শার্ট তখনো তাঁর কারখানায় পড়ে ছিল। গুলশানের হামলায় স্টার ইন্টারন্যাশনালের বায়িং হাউস ফেডো ট্রেডিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ক্লাউদিয়া দাস্তোনাও নিহত হন। সব মিলিয়ে ওই পোশাক রপ্তানি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। ১ জুলাইয়ের জঙ্গি হামলার পর ৩ জুলাই শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘জানি না, কপালে কী আছে।’ শামসুল হকের সঙ্গে গত রোববার রাতে আবার কথা হয়। তিনি বলেন, ‘স্টার ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁরা শিগগিরই আমার কারখানায় এসে পোশাকগুলো আবার পরিদর্শন করবেন। তারপর সেগুলো রপ্তানি হবে।’