বিদেশের সঙ্গে লেনদেনে বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের উদ্বৃত্ত রয়েছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যানে এ উদ্বৃত্ত আরও বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে ৪১২ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত রয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৩ কোটি ডলার বেশি। এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে লেনদেন ভারসাম্যে ৩৫৯ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।
অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ এই উদ্বৃত্তকে খুব স্বস্তিদায়ক বা ইতিবাচক মনে করছেন না। তারা বলছেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে যে চাহিদা থাকার কথা, তা না থাকায় এই উদ্বৃত্ত তৈরি হচ্ছে। একে অর্থনীতির ‘মেদ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরুপাক্ষ পাল। আর বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেন দেখছেন অর্থনীতির মিশ্র চিত্র হিসেবে।
প্রধানত রফতানি আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি ও আমদানিতে কম প্রবৃদ্ধির কারণে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে উদ্বৃত্তের পরিমাণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়কালে আমদানি ও রফতানি পার্থক্য অর্থাৎ বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬২৬ কোটি ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের একই সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৬৬৯ কোটি ডলার। এই ১১ মাসে সেবা বাণিজ্যে আগের বছরের তুলনায় ঘাটতি কমেছে। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে সেবা খাতে ২২৮ কোটি ডলার ঘাটতি হয়েছে; যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৮৫ কোটি ডলার।
এফওবি (পরিবহন ও জাহাজীকরণ ব্যয় ছাড়া) ভিত্তিতে আলোচ্য ১১ মাসে আমদানি ব্যয় হয়েছে তিন হাজার ৬১৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৫ দশমিক ২২ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে রফতানি আয় হয়েছে দুই হাজার ৯৯১ কোটি ৯০ লাখ ডলার। রফতানি আয় বেড়েছে ৮ দশমিক শূন্য এক শতাংশ। এ সময়ে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ২৯৩ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২২১ কোটি ডলার। এদিকে আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত আগের বছরের তুলনায় কমেছে। বিদায়ী অর্থবছরের ১১ মাস শেষে এ খাতে উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ১৩২ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৭৮ কোটি ডলার।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, লেনদেন ভারসাম্যের বর্তমান অবস্থা অর্থনীতির ওপর মিশ্র প্রভাব ফেলেছে। রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু রেমিট্যান্স কমে গেছে। এছাড়া আমদানিতে প্রবৃদ্ধি কম। মূলধনী যন্ত্রপাতি ও নির্মাণ সামগ্রীর আমদানি বাড়ছে না। অর্থাৎ ব্যবসায় এক ধরনের স্থবিরতা রয়েছে। এদিকে বস্ত্র ও পোশাক খাতে এফডিআই বেড়েছে। সব মিলিয়ে এটিকে অর্থনীতির মিশ্র অবস্থা বলতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল সমকালকে বলেন, উদ্বৃত্ত হচ্ছে এটা ঠিক। তবে এই উদ্বৃত্ত আর্থিক খাতের মেদ বৃদ্ধির সংকেত। কারণ বাংলাদেশের মতো গতিশীল অর্থনীতিতে আমদানির ব্যাপক চাহিদা থাকার কথা, তা বর্তমানে দেখা যাচ্ছে না। এজন্য তিনি সরকারকে চলমান মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও নতুন প্রকল্প নেওয়ার আহ্বান জানান, যাতে উৎপাদনশীল খাতে আমদানি চাহিদা বাড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, রেমিট্যান্স কিছুটা কমলেও রফতানি খাত তুলনামূলক শক্তিশালী থাকা ও আমদানি ব্যয় পরিমিত থাকার কারণে বাংলাদেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত বেড়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও অন্যান্য পণ্যের মূল্য কম থাকায় আমদানির জন্য কম ব্যয় হচ্ছে। এটিই লেনদেনের ভারসাম্যের স্বস্তিদায়ক অবস্থার মূল কারণ।
এদিকে আলোচ্য সময়ে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আগের অর্থবছরের তুলনায় সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। তবে এ সময়ে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। গত ১১ মাসে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে ১১ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার।