সময়ের ব্যবধানে তিনটি ঘোষণায় আন্তর্জাতিক বাজার হারাচ্ছে পাট। অস্তিত্ব সংকটে পড়েছেন রফতানিকারকরা। ১৯৮৪, ২০০৯-১০ ও ২০১৫-১৬ সালে তিন দফায় সরকার কাঁচা পাট রফতানি বন্ধের ঘোষণা দেয়। আর এটাই কাল হয়েছে। রফতানিকারকের সংখ্যা ২শ’ থেকে ৩০ জনে নেমে এসেছে। তাদের ব্যাংক ঋণের বোঝা বেড়ে চলেছে। মিলগুলোর উৎপাদিত পণ্যের বাজার ক্রমে সংকুচিত হয়ে আসছে। সব মিলিয়ে বৈরী পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের প্রভাবশালী সদস্য খুলনার নুরুল হক বলেন, ২০১৩ সালে তিন মাস ও ২০১৪ সালে চার মাস দেশব্যাপী আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও নাশকতার কারণে পাটের ব্যবসা বন্ধ থাকে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণের সুদ বন্ধ থাকেনি। এর সঙ্গে আছে বিশ্বমন্দা। পাশাপাশি সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কেলেংকারির কারণে ব্যাংকটি গত চার বছর ঋণ বৃদ্ধি করেনি। ফলে অনেক রফতানিকারকের ব্যবসা বন্ধ হওয়ার পথে।
খুলনার অপর পাট রফতানিকারক ব্যবসায়ী এএম হারুনার রশিদ (সিআইপি) বলেন, ‘বিশ্বে একমাত্র কাঁচা পাট রফতানিকারক দেশ বাংলাদেশ। উৎপাদিত পাটের অর্ধেক দিয়ে দেশের মিলগুলোর চাহিদা পূরণ হয়। বাকি অর্ধেক পাট রফতানিযোগ্য। এবার দেশে ৭৫ থেকে ৮০ লাখ বেল পাট উৎপাদন হবে। দেশীয় মিলের চাহিদা ৪৫ লাখ বেল। এ ক্ষেত্রে রফতানি যদি হয় ৯ লাখ বেল তাহলে বাকি পাট উদ্বৃত্ত থেকে যাবে। তিনি বলেন, খুলনা ও নারায়ণগঞ্জ মিলে দেশে কাঁচা পাট রফতানিকারকের সংখ্যা আড়াইশ’র মতো। এর মধ্যে খুলনারই প্রায় ২শ’। তবে খুলনা ও নারায়ণগঞ্জ মিলিয়ে ২৫-২৬ জন ব্যবসায়ী নিয়মিত রফতানি করলেও বর্তমানে কোনো রফতানি নেই।
গত ৩৫ বছরে সরকারের তিনটি আকস্মিক ঘোষণা রফতানিকারকদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। ১৯৮৪ সালে সরকার কাঁচা পাট রফতানি বন্ধের ঘোষণা দেয়। এতে যুক্তরাজ্য, জাপান, কিউবাসহ ৪-৫টি দেশের বাজার হারায় পাট। ২০০৯-১০ সালে একই ঘোষণায় চীন, ইরান, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের বাজার হারায় বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০১৫-১৬ সালে কাঁচা পাট রফতানি বন্ধের ঘোষণায় চীনের অবশিষ্ট মিলসহ বাংলাদেশী পাটের ওপর নির্ভরশীল পাকিস্তানের অনেক মিল বন্ধ হয়ে যায়। বেসরকারি জুট মিল মালিকদের সংগঠন জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি শহিদুল করিম মুঠোফোনে যুগান্তরকে বলেন, পাটের সুতা ও অন্যান্য পাটজাত পণ্য রফতানিও কমে গেছে। সুতা উৎপাদনের জন্য সারা দেশে ৯৭টি জুট স্পিনিং মিল থাকলেও ২০টি বন্ধ। আর সুতা, বস্তাসহ পাটজাত পণ্য উৎপাদনকারী মিলের সংখ্যা ১১০টির মতো। এর মধ্যে ৩৭টি বন্ধ। এসব মিল থেকে বছরে ৮ লাখ টন পাটজাত পণ্য বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়। তবে এসব পণ্যের মধ্যে ৭০ শতাংশই পাটের সুতা। বিশ্বমন্দা ও পলি ব্যাগের দাপটে পাটপণ্যের বাজার বিস্তৃত হচ্ছে না।
এদিকে স্থানীয় সূত্রমতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ঘটনা বাদেও এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীর অতি লোভ, পাটের গুদামে রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ড ও নানা অপকৌশলে ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণে এ ব্যবসা ঝুঁকিতে পড়েছে। কেউ কেউ সারা বছর এক বেল পাট রফতানি না করেও ব্যবসার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে নিজে এবং স্ত্রী, পুত্র ও আত্মীয়স্বজনের নামে শত শত কোটি টাকা ঋণ নেয়ায় এ সেক্টরেও ‘হলমার্ক’ কেলেংকারির আশংকা করছেন অনেকে। বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) খুলনা জোনের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা মহব্বত আলী মিয়া যুগান্তরকে বলেন, দেশে বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণাধীন ২২ সরকারি জুট মিল চালু আছে। এসব মিলে পাট ক্রয়ের জন্য ২৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। প্লাটিনাম জুট মিলের সিবিএ সেক্রেটারি খলিলুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, কোনো বছরই পাট ক্রয়ের মৌসুমে সরকারি জুট মিলগুলোকে সময়মতো টাকা দেয়া হয় না। লোকসানের এটাও অন্যতম কারণ।