মানিকগঞ্জের রাইজিং স্পিনিং মিল ১১০ কোটি টাকার সম্প্রসারণ প্রকল্প হাতে নিলেও এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া আপাতত স্থগিত রেখেছে মিল কর্তৃপক্ষ। গ্যাস খাতের কোম্পানি-গুলোর প্রস্তাব অনুযায়ী দাম বাড়লে প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যেতে পারে। রাইজিং গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান এমন তথ্য দিয়ে গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটর দিয়ে স্পিনিং মিলটির জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করি। তাতে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের দাম পড়ে ৪ টাকা ২০ পয়সা। এখন গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব কার্যকর হলে প্রতি কিলোওয়াটের দাম হবে সাড়ে ৯ টাকার ওপরে।’
মাহমুদ হাসান আরও বলেন, ‘গ্যাসের দাম এভাবে বাড়লে প্রতি কেজি সুতার দাম ৪০-৫০ সেন্ট বেড়ে যাবে। তাতে করে আমাদের সুতা কেউ কিনবে না। ভারত ও চীনের সুতার সঙ্গে আমরা এত দিন প্রতিযোগিতা করতে পেরেছি। কারণ, জ্বালানি খরচ কম। সেটিই যদি না থাকে, তবে মিলের সম্প্রসারণ করে ঝুঁকি কেন নেব?’ মাহমুদ হাসানের মতো বস্ত্র খাতের অধিকাংশ ব্যবসায়ীই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। তবে এর নেতিবাচক প্রভাব শেষ পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়ের খাত তৈরি পোশাকশিল্পের ওপরেই পড়বে। তাতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমবে। এমন আশঙ্কায় পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ীরাও বিষয়টি নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন।
কেবল বস্ত্র খাতই নয়, গ্যাসের দাম বাড়লে বাড়বে রডের উৎপাদন খরচও। তাতে ছোট কারখানাগুলো বিপদে পড়বে। রডের মূল্যবৃদ্ধি সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পেও প্রভাব ফেলবে, ব্যয় বাড়বে। দেশে বর্তমানে রড তৈরির ৩০টির মতো অটো রি-রোলিং মিল আছে। সম্প্রতি গ্যাস খাতের বিভিন্ন কোম্পানি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) সব শ্রেণির গ্রাহকের ক্ষেত্রে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে। এতে ক্যাপটিভ জেনারেটরে ব্যবহৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৮ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে ১৩০ শতাংশ বৃদ্ধি করে ১৯ দশমিক ২৬ টাকা এবং প্রতি ঘনমিটার ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্যাসের দাম ৬ টাকা ৭৪ পয়সা থেকে ৬২ শতাংশ বাড়িয়ে ১০ টাকা ৯৫ পয়সা করার প্রস্তাব আছে। বিইআরসিতে এ বিষয়ে গণশুনানি চলছে।
বস্ত্রকলমালিকদের সংগঠন বিটিএমএর দেওয়া তথ্য হচ্ছে, গত বছরের আগস্টে ক্যাপটিভ জেনারেটরের জন্য প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ছিল ৪ টাকা ১৮ পয়সা। গত সেপ্টেম্বরে সেটি ৮ টাকা ৩৬ পয়সা করা হয়। বর্তমানের প্রস্তাব আমলে নিলে গত এক বছরে ক্যাপটিভের গ্যাসের দাম বাড়ছে ৪৬০ শতাংশ। শেষ পর্যন্ত এটি কার্যকর হলে প্রতি কেজি সুতা উৎপাদনে গ্যাসের খরচ ১৩ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বেড়ে ৩০ টাকা ৩৩ পয়সা হবে। বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, সুতা উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল তুলার দাম সম্প্রতি বিশ্ববাজারে ১৫ শতাংশ বেড়েছে। এখন আবার গ্যাসের দাম বাড়লে সুতার উৎপাদন খরচ আরও বাড়বে। সুতার দাম বাড়ালে বস্ত্রকলগুলো মুখ ফিরিয়ে নেবে। ভারত থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় সুতা আমদানিতে উৎসাহিত হবে মিলগুলো। বর্তমানে দেশে ৪৩০টি স্পিনিং মিল আছে।
জানতে চাইলে বিটিএমএর সাবেক সভাপতি ও মালেক স্পিনিং মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ মতিন চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এক বছরের ব্যবধানে ক্যাপটিভ জেনারেটরে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়বে ৪৬০ শতাংশ। এই ধাক্কা সামলানোর মতো সক্ষমতা দেশের কোনো শিল্প কারখানার নেই। বিষয়টি সরকারকে বুঝতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘গ্যাসের দাম বাড়ালে আমাদের স্পিনিং মিলের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা শেষ হয়ে যাবে। এখন ভারত থেকে হয়তো কম দামেই সুতা পাওয়া যাবে। তবে পাঁচ বছর পর তারা সুতার দাম বাড়িয়ে দিলে আমাদের বস্ত্র ও পোশাক—দুটো খাতই ধ্বংস হয়ে যাবে।’
ভারত তিন বছরের মধ্যে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যাওয়ার একটি পরিকল্পনা নিয়েছে। সে জন্য দেশটির সরকার ছয় হাজার কোটি রুপির বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। বিষয়টি উল্লেখ করে মতিন চৌধুরী বলেন, পোশাকশিল্প টিকিয়ে রাখতে পশ্চাৎমুখী সংযোগশিল্পকে শক্তিশালী রাখা খুবই প্রয়োজন। অবশ্য পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য শামসুল আলম গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পৃথিবীর বহু দেশ শিল্পোন্নত হয়েছে, যাদের এক ফোঁটা গ্যাসও ছিল না। যেমন দক্ষিণ কোরিয়া। আমাদের দেশ সৌভাগ্যক্রমে গ্যাস পেয়েছে। সরকার সেটি উত্তোলন করে পানির দামে দিয়েছে। এখন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান ও জ্বালানির বিকল্প ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রচুর রাজস্ব দরকার। তার কিছুটা হলেও ব্যবসায়ীদের বহন করতে হবে।’
পোশাক কারখানাগুলোয় বর্তমানে ক্যাপটিভ জেনারেটরের সংখ্যা কম। ফলে গ্যাসের দাম বাড়লে খাতটিতে সরাসরি প্রভাব কম পড়বে। তবে পরোক্ষ প্রভাব অনেক বড়। পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ীরা বলছেন, নিট পোশাকের ৯০ শতাংশ কাপড় এবং ওভেন পোশাকের ৩৫-৪০ শতাংশ কাপড় দেশের বস্ত্রকলগুলো জোগান দেয়। এ জন্য কম সময়ে কাপড় পাওয়া যায়। রপ্তানির সময় বা ‘লিড টাইম’ কম লাগে, যা পোশাক রপ্তানিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই পোশাকশিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে শক্তিশালী বস্ত্র খাতের কোনো বিকল্প নেই। সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার কারণে দেশে-বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর একধরনের চাপ পড়েছে। এ রকম এক সময়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সঠিক নয় বলে মনে করেন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। গত রোববার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্যাসের দাম বাড়লে সুতা ও কাপড়ের দাম বাড়বে। শেষ পর্যন্ত এটি পোশাকশিল্পের ঘাড়েই এসে পড়বে। আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাবে। বিষয়টি সরকারের মাথায় রাখা উচিত।’
বিজিএমইএর সভাপতি আরও বলেন, ‘গ্যাস ও বিদ্যুতের নতুন সংযোগ এবং চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের চাপ—কোনোটাই পাচ্ছি না। এই অবস্থায় আবার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব যুক্তিসংগত নয়।’ তিনি বলেন, তিন বছর পর তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আসবে। সে জন্য গ্যাসের দাম বাড়াতে হলে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন। জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি গ্যাসের দাম বাড়ানোর পক্ষে। তবে তিন-চার বছরের পরিকল্পনা করে ধীরে ধীরে গ্যাসের দাম বাড়ানো উচিত। এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন, তাঁদের শিল্প কারখানা কতটুকু দাম দেওয়ার সক্ষমতা রাখে।’
ম তামিম আরও বলেন, হঠাৎ করে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করে দিলে স্পিনিং মিল সামলাতে পারবে না। মিল বসে যেতে বাধ্য। তেমনটি হলে ভারতের ব্যবসায়ীদের কাছে ব্যবসা তো যাবেই। সে জন্য প্রয়োজন অনুসারে সরকারকে অবশ্যই যাচাই-বাছাই করে কিছু জায়গায় মূল্যছাড় দিতে হবে। লৌহ ও ইস্পাতশিল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও লোহা প্রক্রিয়াজাত করতে বয়লার চালানোর জন্য গ্যাসের ব্যবহার হয়। গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে বস্ত্র ও পোশাকশিল্পের পরই লৌহ ও ইস্পাতশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বে ছোট কারখানাগুলো। গত সপ্তাহে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইস্পাত খাতের বড় প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আলীহুসাইন আকবরআলী বলেন, নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়লে ইস্পাত খাতে রডসহ অন্যান্য পণ্যের উৎপাদন খরচ টনপ্রতি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বাড়বে।
অবশ্য ভিন্নমত জানিয়ে বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং অ্যান্ড স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএআরএসএমএ) চেয়ারম্যান শেখ মাসাদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের দাম বাড়লে রডের কাঁচামাল বিলেট উৎপাদনের খরচ বাড়বে, রড উৎপাদনেও খরচ বাড়বে। সব মিলিয়ে প্রতি টন রডের উৎপাদন খরচ পাঁচ হাজার টাকার মতো বৃদ্ধি পেতে পারে। মাসাদুল আলম আরও বলেন, ‘আমরা তো নিজের ইচ্ছায় ক্যাপটিভ বসাইনি। সরকার বিদ্যুৎ দিতে পারে নাই বলেই আমরা বিপুল টাকা বিনিয়োগ করে সেটি করেছি। এখন তারাই আবার বন্ধ করতে বলছে। তবে ক্যাপটিভে যে বিনিয়োগ হয়েছে, সেটি উঠিয়ে আনার সুযোগ তো দিতে হবে।’ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শামসুল আলম বলেন, ‘সুনির্দিষ্টভাবে পরিকল্পনা করে এগোলে ভালো হয়। কারণ, ঘন ঘন দাম পরিবর্তন করলে ব্যবসায়ীরাও পরিকল্পনা করতে পারেন না। অবশ্য বিশ্বের অনেক কিছুর দামই এখন হঠাৎ করে পরিবর্তন হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা আজ যে দামে পণ্য বিক্রি করছেন, কাল হয়তো আবার একই পণ্যে বেশি দাম পাচ্ছেন।’ তিনি ব্যবসায়ীদের উৎপাদন সক্ষমতা, নতুন প্রযুক্তি আনা, শ্রমিকদের দক্ষ করার ওপর জোর দেন; যাতে করে গ্যাসের বাড়তি দামের ধাক্কা অন্যদিক থেকে সামলে ওঠা যায়।