মালয়েশিয়ার সঙ্গে সম্ভাব্য মুক্তবাণিজ্য চুক্তিতে জনশক্তি অন্তর্ভুক্ত হলে লাভবান হবে বাংলাদেশ। নইলে এ চুক্তি করে বিশেষ কোনো সুবিধা পাবে না বাংলাদেশ। কারণ, মুক্তবাণিজ্য চুক্তি হলেও এ দেশের রপ্তানি আয় খুব বেশি বাড়বে না। অন্যদিকে মালয়েশিয়ার চেয়ে বেশি হারে রাজস্ব হারাতে হবে বাংলাদেশকে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে প্রস্তাবিত মুক্তবাণিজ্য চুক্তির প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
মালয়েশিয়ার সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তির বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় আছে। জানা গেছে, চুক্তিটি করার ব্যাপারে মালয়েশিয়া ব্যাপক আগ্রহী। তবে বাংলাদেশ আরও বিচার-বিশ্লেষণ করতে চায়। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনটি নিয়ে আলোচনার জন্য একটি বৈঠক করে। তবে চুক্তিটি হবে কি না, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তিটি নিয়ে বাংলাদেশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। দ্বিপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি হলে দুই দেশ নিজেদের কিছু পণ্য বাদে বাকি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়। এ ধরনের চুক্তির মূল সুবিধা হলো দুই দেশ নিজেদের পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে পারে। বিপরীতে সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে পণ্য আমদানিতে যে আমদানি শুল্ক পাওয়া যেত, তার সিংহভাগ হারাতে হয়।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশ ১২৮ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে জানানো হয়, মালয়েশিয়ার সব পণ্যের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক তুলে নেওয়া হলে বাংলাদেশের রাজস্ব আয় কমবে প্রায় ১১ কোটি ৪৬ লাখ ডলার, যা দেশের মোট আমদানি শুল্কের শূন্য দশমিক ৮০ শতাংশ। অন্যদিকে মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ আরও কম হবে।
মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে ৪৯টি পণ্য। মালয়েশিয়া থেকে পাওয়া মোট আমদানি শুল্কের ৮০ শতাংশই আসে এসব পণ্য থেকে। ট্যারিফ কমিশন বলেছে, সংবেদনশীল পণ্যের তালিকা, অর্থাৎ যেসব পণ্যে বাংলাদেশ শুল্ক ছাড় দেবে না, সেই তালিকা যাচাই-বাছাই করে তৈরি করা হলে নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে রাখা যাবে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ মালয়েশিয়ায় ১৪ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। ট্যারিফ কমিশনের তথ্যমতে, ছয় অঙ্কের এইচএস কোডে (বৈশ্বিক বাণিজ্যে ব্যবহৃত পণ্যের অভিন্ন কোড নম্বর) মোট পণ্যসংখ্যা ৩৫৩। এর মধ্যে ২৪৬টি পণ্যে শুল্ক দিতে হয়নি। বাংলাদেশের প্রধান পণ্য তৈরি পোশাক এখন মালয়েশিয়াতে শুল্কমুক্তভাবে রপ্তানি হয়। ট্যারিফ কমিশন বলেছে, মুক্তবাণিজ্য চুক্তি হলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে, তবে তা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নয়। পাশাপাশি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানিতে ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তির প্রভাবও হবে সামান্য।
যুক্তরাষ্ট্র ১১টি দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্যের লক্ষ্যে টিপিপি চুক্তি করেছে। মালয়েশিয়াও ওই ১১ দেশের মধ্যে আছে। ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মালয়েশিয়া টিপিপি সদস্যদের শতভাগ শুল্কমুক্ত সুবিধা দিলে বাংলাদেশ প্রায় চার লাখ ডলারের রপ্তানি হারাতে পারে। উল্লেখ্য, এ সংখ্যা ওই দেশে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ২ শতাংশ। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন খাতে জনশক্তির চাহিদা বেশ ভালো হারে বাড়ছে। সর্বশেষ অর্থবছরে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির পরিমাণও বেড়েছে। তবে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার সেবা খাতে বাংলাদেশের জন্য উন্মুক্ত কেবল বৃক্ষরোপণ খাত। অন্যদিকে থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার জন্য সব খাত উন্মুক্ত। ভারতের জন্যও নির্মাণ (হাই টেনশন কেব্ল), খুচরা ব্যবসা, রেস্তোরাঁ, কৃষি ও বৃক্ষরোপণ, চুলকাটা, বস্ত্রসহ বিভিন্ন খাত উন্মুক্ত।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ আগামী তিন বছরে মালয়েশিয়ায় ১৫ লাখ শ্রমিক পাঠানোর জন্য একটি সমঝোতা চুক্তি করেছিল। তবে ফেব্রুয়ারি মাসে এ চুক্তির পরদিনই মালয়েশিয়া জানিয়ে দেয়, তারা কোনো দেশ থেকেই জনশক্তি নেবে না। ট্যারিফ কমিশন বলেছে, এখন মালয়েশিয়ার সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তির ক্ষেত্রে জনশক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করে আলোচনার উপযুক্ত সময়। বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া চেম্বারের সভাপতি আলমগীর জলিল বলেন, মালয়েশিয়া চায় এ চুক্তিটি হোক। বাংলাদেশের উচিত তাদের স্বাগত জানানো। তবে দর-কষাকষি করে বাংলাদেশকে জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মালয়েশিয়ার জনশক্তি দরকার।