বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা উৎসে কর ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে বলে এনবিআরের এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। সম্প্রতি করা এ সমীক্ষায় এই ফাঁকি বন্ধ করে ওই পরিমাণ অর্থ আদায়ের জন্য নানা কৌশলের কথা বলা হয়েছে। এনবিআর বলছে, এ ফাঁকি বন্ধ করা গেলে আয়কর খাতে রাজস্ব আদায় অনেক বৃদ্ধি পাবে। সমীক্ষায় বলা হয়, আয়কর আদায়ে সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে উৎসে কর। এটা আদায়ে বড় ধরনের গলদ রয়েছে। যে পরিমাণ কর আদায়ের কথা, তা হচ্ছে না। গত অর্থবছর মোট আয়কর আদায় হয়েছে ৫৪ হাজার কোটি টাকা। এই আয়করের শতকরা ৫৭ শতাংশ এসেছে উৎসে কর খাত থেকে। এনবিআরের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ফাঁকি বন্ধ করতে পারলে করহার বৃদ্ধি কিংবা আওতা বাড়ানোর তেমন প্রয়োজন হবে না।
এনবিআর বলছে, বেশ কয়েকটি প্রক্রিয়ায় উৎসে কর ফাঁকি দেওয়া হয়। এগুলো হলো_ ঠিকমতো কর কর্তন না করা, বিদ্যমানের চেয়ে কম হারে কর কাটা, কর্তন করা হলেও সেই অর্থ জমা না দেওয়া কিংবা যে হারে কাটা হয়েছে, তার চেয়ে কম জমা দেওয়া এবং ভুয়া সনদ ইস্যু করা ইত্যাদি। উৎসে কর খাতে ফাঁকি বন্ধে এবারের বাজেটে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে; তৈরি করা হয়েছে তদারকি ব্যবস্থা। উদাহরণ দিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, আবদুল বাসেত একজন ঠিকাদার ব্যবসায়ী।
তিনি ১০ কোটি টাকায় একটি সরকারি ভবন নির্মাণের কার্যাদেশ পান। কাজ শেষে বিল তোলার সময় প্রযোজ্য হারে উৎসে কর কর্তনের পর অবশিষ্ট বিল তাকে দেওয়ার কথা। ঠিকাদারি ব্যবসাসহ এ রকম ৫৮টি খাত থেকে বর্তমানে বিভিন্ন হারে উৎসে কর আদায় করা হয়। এখন পর্যন্ত উৎসে করের সর্বোচ্চ হার ৩০ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। আয়কর আইন অনুযায়ী, যে সংস্থার ঠিকাদারি কিংবা সরবরাহ কাজ করা হয়, সে সংস্থাই ঠিকাদারকে বিল পরিশোধের সময় উৎসে কর কেটে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়। এ জন্য তাকে ‘উৎসে কর কর্তনকারী কর্তৃপক্ষ’ বলা হয়। কারণ, উৎসে কর এনবিআরের কর্মকর্তারা সরাসরি আদায় করেন না।
এনবিআরের সমীক্ষা অনুযায়ী, উৎসে করের সবচেয়ে বড় খাত হলো ঠিকাদারি ব্যবসা। কিন্তু এ খাতে সবচেয়ে বেশি কর ফাঁকি হয়। এতে বলা হয়, এ খাতে আদায়যোগ্য করের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশই আদায় হয় না। বর্তমানে সারাদেশে ঠিকাদার ও সরবরাহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। উৎসে করের আরেকটি অন্যতম খাত হচ্ছে চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা। বর্তমানে এ খাত থেকে আদায় হয় মোট আয়করের মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ। সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়, চাকরিজীবীদের সংখ্যাও বেতন কাঠামো অনুযায়ী আদায় হওয়ার কথা কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ শতাংশ। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, উৎসে করের এই খাতে বিশাল ফাঁকি হচ্ছে। গত বছর বেতন-ভাতা বাবদ উৎসে কর থেকে আয় হয়েছে মাত্র ৯০০ কোটি টাকা। এনবিআরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, নিবিড় তদারক ও ফাঁকফোকর বন্ধ করতে পারলে এখান থেকে অন্তত চার-পাঁচ গুণ বেশি আদায়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
এনবিআর বলছে, ফ্রেইট ফরওয়ার্ড এজেন্সি, শিপিং এজেন্সি, বিদেশি প্রতিষ্ঠান, ইটভাটা, ট্রাভেল এজেন্ট, কনসালট্যান্সি সার্ভিস, ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে, হাউস প্রপার্টি, জনশক্তি রফতানি, রফতানি, আবাসন ইত্যাদি খাতে ব্যাপক কর ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। সূত্র জানায়, ঠিকাদার খাতে ব্যাপক কর ফাঁকি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এবারের বাজেটে আইন কঠোর করা হয়েছে। নতুন নিয়মে এক চেকে বিল পরিশোধ এবং ‘চুক্তিমূল্যের’ (কনটাক্ট ভ্যালু) ওপর প্রযোজ্য হারে কর কর্তন করতে হবে। আগে একাধিক চেকে বিল পরিশোধের নিয়ম চালু থাকায় চুক্তিমূল্য কম দেখিয়ে কর ফাঁকির সুযোগ ছিল।
যোগাযোগ করা হলে এনবিআরের সাবেক আয়কর সদস্য আমিনুর রহমান বলেন, উৎসে কর আদায়ে ব্যাপক গলদ রয়েছে। আছে আইনের জটিলতা ও অসঙ্গতি। এগুলো দূর করতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশেই উৎসে কর আদায়ের ক্ষেত্রে রিফান্ড বা ফেরত দেওয়ার বিধান চালু আছে। আমাদের দেশে এ সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। এটা ন্যায়নীতির পরিপন্থী বলে তিনি মন্তব্য করেন। আরেক সাবেক সদস্য সৈয়দ আমিনুল করিম বলেন, উৎসে করে বিশাল ফাঁকি চলছে। এ ফাঁকি বন্ধে প্রয়োজন শক্তিশালী তদারকি ও বাধ্যতামূলক অডিট ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। তিনি মনে করেন, উৎসে করে ফাঁকি বন্ধ করতে পারলে প্রতিবছর বাজেটে দেওয়া আয়করে লক্ষ্যমাত্রা সহজেই অর্জন করা সম্ভব। উল্লেখ্য, চলতি ২০১৬-১৭ বাজেটে আয়কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭১ হাজার কোটি টাকা।
যেসব সংস্কার করা হয়েছে :কর আদায় বাড়াতে এবারের বাজেটে উৎসে কর খাতে তদারকি কঠোর করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে এনবিআরে কেন্দ্রীয়ভাবে সেন্ট্রাল ইউনিট গঠন করা হবে। এই ইউনিটের আওতায় আরও পাঁচটি কর অঞ্চল গঠিত হবে, যাদের কাজ হবে শুধু উৎসে কর আদায় তদারক করা। ফাঁকি বন্ধে এ খাতের জন্য প্রথমবারের মতো অডিট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। জানুয়ারি ও জুনে বছরে দু’বার অডিট করা হবে। কত কর আদায় করা হলো, কী হারে কর্তন করা হলো, কত জমা দেওয়া হলো_ এসব বিষয়ে তদারক করা হবে। বর্তমানে ব্যক্তি ও কোম্পানি আয়কর রিটার্ন দাখিল করে থাকে। নতুন নিয়মে যে প্রতিষ্ঠান থেকে উৎসে কর কেটে রাখা হবে, তাদেরও বাধ্যতামূলক রিটার্ন জমা দিতে হবে।
উৎসে কর আদায়ের ক্ষেত্রে জবাবদিহির ব্যবস্থা করা হয়েছে নতুন বাজেটে। উৎসে কর ঠিকমতো না কাটলে কিংবা সরকারি কোষাগারে জমা না দিলে তার দায়ভার সংশ্লিষ্ট কর্তন বা আদায়কারী প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার ওপর বর্তাবে। উৎসে কর আদায়ে ফাঁকির ঘটনা প্রমাণিত হলে দায়ী প্রতিষ্ঠানকে সমপরিমাণ ফাঁকির টাকা তার সঙ্গে ‘অতিরিক্ত’ ২ শতাংশ পরিশোধ করতে হবে। আগে এক অর্থবছরের পাওনা উৎসে কর-পরবর্তী অর্থবছরেও দেওয়া যেত। নতুন নিয়মে এ বিধান বাতিল করে চলতি অর্থবছরের মধ্যে পুরো পাওনা কর পরিশোধ করতে হবে। এনবিআর সূত্র বলেছে, উৎসে কর আদায়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এ নিয়ম করা হয়েছে।