হাতিরঝিলে বিজিএমইএ ভবন l ফাইল ছবিহাতিরঝিলের জায়গায় নির্মিত ১৪ তলা বিজিএমইএ ভবনটি শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা যাবে না, ভাঙতেই হবে। শিগগিরই খুঁজতে হবে নতুন ঠিকানা। আপিল বিভাগের রায়ের পর এমনটাই মনে করছেন বিজিএমইএর শীর্ষ নেতারা। সংগঠনের নতুন ভবন নির্মাণের জন্য জমি খোঁজার কাজও শুরু করে দিয়েছেন তাঁরা। তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর শীর্ষ নেতারা জানান, ভবন ভাঙার বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর সব আশা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। ভবনটি ছাড়তে এখন মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন নেতারা। সম্মানজনক প্রস্থান নিয়েই চিন্তিত তাঁরা। তবে নিয়ম রক্ষার জন্য হলেও শেষ আইনি লড়াই বা রিভিউ আবেদন করবে সংগঠনটি।
২০১১ সালের ৩ এপ্রিল বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ জমির স্বত্ব না থাকা ও জলাধার আইন লঙ্ঘন করে নির্মিত বিজিএমইএ ভবন ভাঙার নির্দেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে বিজিএমইএ লিভ টু আপিল করে। গত ২ জুন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ বিজিএমইএর আপিল আবেদন খারিজ করে দেন। আপিল বিভাগের রায়ের পর গত আড়াই মাসে বিজিএমইএর বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক কথা বলেন। তাঁদের একটি অংশ মনে করে, ভবনটি বাঁচানোর আর কোনো সুযোগ নেই। তবে আরেক পক্ষের আশা, সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে অনুরোধ করলে হয়তো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে। সে অনুযায়ী কয়েক দফা চেষ্টা করেছেন বিজিএমইএর শীর্ষ নেতারা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক মনোভাব পাওয়া যায়নি।
এরপরই নতুন ভবন নির্মাণের জন্য বিজিএমইএর নেতারা তেজগাঁও শিল্প এলাকা, আগারগাঁও, পূর্বাচল ও উত্তরায় সরকারি খাসজমির খোঁজ-খবর নেন। শেষ পর্যন্ত উত্তরা তৃতীয় পর্যায়ে চারটি প্লটে থাকা ১০ বিঘা আয়তনের একটি খাসজমির খোঁজ পাওয়া যায়। গত মাসে জমিটি সরেজমিনে দেখেও এসেছেন সংগঠনের কয়েকজন নেতা। বিষয়টি প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের কাছে স্বীকারও করেন বিজিএমইএর একাধিক নেতা। সংগঠনটির প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আপিল বিভাগের রায়ের পর বিজিএমইএর নেতারা জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে তাতে তেমন লাভ হবে না ভেবে শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে আসেন তাঁরা। এমনকি কার্যালয়ের পঞ্চম তলায় পুরো ফ্লোরটির সংস্কারকাজ শুরু হলেও রায়ের পর সেটি স্থগিত রাখা হয়। মাঝপথে কাজ বন্ধ করায় ১ কোটি টাকার মতো লোকসান হয়েছে বিজিএমইএর।
১৯৯৮ সালের নভেম্বরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিজিএমইএ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০৬ সালের অক্টোবরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ভবনটির উদ্বোধন করেন। বিজিএমইএ জানায়, রাজধানীর হাতিরঝিল প্রকল্পে সোনারগাঁও হোটেলের পাশে ১৪ তলা বিজিএমইএ ভবনটির মোট এলাকা বা স্পেস ২ লাখ ৬৫ হাজার বর্গফুট। এর মধ্যে ১ লাখ ৪০ হাজার বিজিএমইএর মালিকানাধীন। বাকি ১ লাখ ২৫ হাজার বর্গফুট জায়গা ৪০টির মতো প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা হয়েছে এবং ভাড়ায় দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া ভবনের ওপরের দুটি ফ্লোর নিয়ে বিলাশবহুল ‘অ্যাপারেল ক্লাব’ করেছে বিজিএমইএ। সেখানে সংগঠনের সদস্যদের জন্য সুইমিং পুল, ব্যায়ামাগার, রেস্টুরেন্ট, সভাকক্ষ ইত্যাদি সুবিধা আছে। মূল ভবনের নিচে বেসমেন্ট গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য অতিরিক্ত দুটি তলা আছে। এ ছাড়া একটি বড় আকারের মিলনায়তনও আছে ভবনটিতে। সব মিলিয়ে পুরো ভবনটিতে থাকা সম্পত্তির মূল্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বলে মনে করেন সংগঠনটির নেতারা।
বিজিএমইএ ভবনের ২৮ হাজার বর্গমিটারের দুটি ফ্লোর কিনে প্রধান কার্যালয় করেছে ডিবিএল গ্রুপ। জানতে চাইলে গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান এম এ রহিম গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিজিএমইএ থেকে আমাদের বলা হয়েছে, জমি খোঁজা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ভবনটি যদি ভাঙতেই হয় এবং নতুন করে অন্য জমিতে ভবন করা হয়, সেখানে আমাদের জায়গা দেওয়া হবে। না হলে কোথাও ভাড়া নিয়ে আমাদের চলে যেতে হবে।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিএমইএর এক শীর্ষ নেতা বলেন, নতুন ভবন তৈরির জন্য সময় দিতে হবে। আর যেসব প্রতিষ্ঠান ভবনের জায়গা কিনেছে, তাদের বিষয়ে তিনি বলেন, বিজিএমইএর তো নিজের বলে কিছু থাকছে না। তাহলে তাদের কীভাবে দেবে? এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি (অর্থ) মোহাম্মদ নাছির গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের পণ্য রপ্তানির ৮২ শতাংশই তৈরি পোশাক খাত থেকে আসে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে মহামান্য আদালত যদি রায়টি পুনর্বিবেচনা করেন, তাহলে পোশাকশিল্পসহ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে না। কারণ এটি কারও ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি নয়, বরং দেশের জাতীয় শিল্পের প্রতীক।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ নাছির আরও বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ রায়টি পাওয়ার পর বিজিএমইএ রিভিউ আবেদন করবে। যে রায় আসবে, সেটি আমরা মেনে নেব। তবে শেষ পর্যন্ত যদি ভবনটি ভাঙতে হয়, তাহলে আমরা আদালতের কাছে এ জন্য কিছু সময় চাইব।’ তিনি জানান, নতুন ভবনের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে উত্তরায় একটি জমি দেখা হয়েছে। গতকাল দুপুরে মুঠোফোনে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।