সাভারের হরিণধরা মোড় থেকে কিছুটা এগোলেই চামড়া শিল্পনগরী। দু’বছর আগেও এখানে ছিল বালুর মাঠ। আর এখন চলছে পাইলিং, দেয়াল, ছাদ ঢালাইসহ বিভিন্ন ধরনের নির্মাণকাজ। দুটি ট্যানারিতে চামড়া বোঝাই ড্রাম ঘুরছে। কয়েকটি ট্যানারিতে যন্ত্র স্থাপনে ব্যস্ত শ্রমিকরা। কেননা দেরিতে হলেও শেষ পর্যন্ত সাভারমুখী হচ্ছেন ট্যানারি মালিকরা। আর এর মূল কারণ আদালতের জরিমানা আরোপ। হাজারীবাগে থাকায় সেখানকার ১৫০ ট্যানারিকে গুনতে হচ্ছে প্রতিদিন মোট ১৫ লাখ টাকার জরিমানা। তাই তারা সাভারে আসার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছেন। কোরবানির আগেই সেখানে চালু হচ্ছে ৩০টি ট্যানারি।
রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে ট্যানারি স্থানান্তরে ১৩ বছর ধরে সরকার চেষ্টা চালাচ্ছে। সব শেষে গত ১০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে সরকার হাজারীবাগে কারখানা বন্ধ করার আলটিমেটাম দেয়। গত মাসে উচ্চ আদালতের রায়ে স্থানান্তরিত না হলে প্রত্যেক ট্যানারিকে প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই থেকে হাজারীবাগের ১৫০ ট্যানারি প্রতিদিন ১৫ লাখ টাকা জরিমানা দিচ্ছে।
পুরোদমে চলছে নির্মাণকাজ: গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে সাভার চামড়া নগরী ঘুরে দেখা গেছে, পুরোদমে চলছে বেশিরভাগ ট্যানারির কাজ। ২০৫টি প্লটে বরাদ্দ পেয়েছে ১৫৫ ট্যানারি। তবে আইনি জটিলতা থাকায় ১২টি ট্যানারির নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। দু-একটি ট্যানারি পাইলিংয়ের কাজ করলেও বেশিরভাগ ট্যানারি ভবন নির্মাণের কাজ করছে। ৯৪টি ট্যানারির ছাদ ঢালাই হয়েছে। এর মধ্যে অনেক ভবনই বহুতলবিশিষ্ট। ৪৭টিতে যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে; কিন্তু স্থাপন করা হয়নি। ২৫টিতে যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। চারটি কারখানা চামড়াও নিয়ে এসেছে।
সম্প্রতি চালু হয়েছে মারসন্স ট্যানারি। রিলায়েন্স লেদার দু’মাস ধরে উৎপাদন করছে। মেশিন স্থাপন করে চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে এপেক্স, ঢাকা হাইড, ফরচুন, প্রিন্স, আজমেরি, ফেন্সি, সাথী, মদিনা, আমিন, সামিনা, বে, নবারুণসহ প্রায় ৩০টি ট্যানারি। তবে সব ট্যানারির কাজ শেষে চালু করতে ছয় মাসের বেশি সময় লাগবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। গত মঙ্গলবার অ্যাসোসিয়েশনের বৈঠক সিদ্ধান্ত হয়েছে, কোরবানির ঈদের চামড়া তারা এবার সাভারে নেবেন। তবে অর্থ সংকটে থাকা ট্যানারিগুলো ডিসেম্বর পর্যন্ত চালু রাখার জন্য আবেদন করা হবে।
প্রকল্পের কাজও বাকি আছে: বিভিন্ন ট্যানারির তত্ত্বাবধায়করা জানান, শুধু মালিকদের কারণেই যে স্থানান্তরে দেরি হচ্ছে, তা নয়। প্রকল্পের কাজও বাকি আছে। পুরোপুরি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ শেষ হয়নি। দু-চারটি ট্যানারি বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ পেলেও অনেকে আবেদন করে এখনও সংযোগ পাননি। কোনো কোনো কারখানায় গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হয়নি। এখনও ওয়েস্ট ডাম্পিং ইয়ার্ড প্রস্তুত হয়নি। চালু দুটি ট্যানারি সলিড ওয়েস্ট বা বর্জ্য কুয়া খনন করে স্তূপ করছে। পরে ট্রাকবোঝাই করে অন্যখানে ফেলে দিচ্ছে। ড্রেন লাইনের বর্জ্য স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় ত্রুটি ও দায়িত্বশীলদের গড়িমসির কারণে সড়কে ছড়িয়ে পড়ছে দুর্গন্ধযুক্ত পানি। এ ছাড়া ব্যবসায়ী, শ্রমিক, প্রকৌশলীসহ ট্যানারি-সংশ্লিষ্টদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও এখনও হয়নি।
এ ব্যাপারে শিল্পনগরীর প্রকল্প পরিচালক আবদুল কাইয়ুম সমকালকে বলেন, ‘কোরবানির ঈদের আগে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) দুটি মডিউল পূর্ণাঙ্গভাবে চালানো হবে। এতে ৩০টির বেশি ট্যানারির বর্জ্য শোধন করা যাবে।’ তিনি বলেন, ‘সলিড ওয়েস্ট ডাম্পিং প্রক্রিয়া ১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হবে। ইতিমধ্যে যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়েছে। যেসব ট্যানারি চালুর প্রক্রিয়ায় আছে তাদের দ্রুত বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ দেওয়া হচ্ছে।’ হাজারীবাগের গ্যাস সংযোগ বন্ধ হলে তারা সাভার শিল্পনগরীর ট্যানারিতে সংযোগ পাবেন বলে জানান তিনি।
ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) সাবেক সভাপতি আবু তাহের সমকালকে বলেন, ‘সাভারে দ্রুত কারখানা চালুর চেষ্টা করছেন সব ট্যানারি মালিকরা। আগামী সপ্তাহে আমার ট্যানারি ফরচুন লেদার চালু করার প্রস্তুতি চলছে।’ তিনি বলেন, ‘ট্যানারিগুলোর হাতে থাকা অর্থ ইতিমধ্যেই বিনিয়োগ করা হয়েছে। এখন অর্থ সংকটে অনেকে কাজ করতে পারছেন না।’ তিনি জানান, সব ট্যানারি স্থানান্তরের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ পেতে প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করবেন তারা। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, ‘সাভারে এরই মধ্যে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে। ঈদের আগেই ৩০টির বেশি ট্যানারি চালু হবে; কিন্তু এখনও পূর্ণাঙ্গভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হয়নি।’
পুরনো বড় ট্যানারি করিম লেদারের কারখানার পাইলিংয়ের কাজ কয়েক মাস আগে শেষ হয়েছে। ট্যানারির চেয়ারম্যান রেজাউল করিম আনসারী মারা যাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ বন্ধ আছে। এদিকে নির্মাণকাজ শুরু হলেও কারখানা চালু করতে ছয় মাসের বেশি সময়ের প্রয়োজন। এতে আগামী ছয় মাসে প্রায় ১৮ লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হবে। করিম লেদারের প্রকৌশলী মো. সাগর বলেন, ‘ঈদের আগেই ট্যানারির নির্মাণকাজ শুরুর চেষ্টা চলছে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে ট্যানারিতে কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত শুরু হবে।’
মারসন্স ট্যানারির মালিক মো. বাবু সমকালকে বলেন, ‘পাঁচ দিনের জরিমানা দিয়ে দ্রুত এ ট্যানারি চালু করা হয়েছে। কিন্তু সলিড ওয়েস্ট ফেলার নির্দিষ্ট কোনো স্থান নেই। তাই বর্জ্য জমে যাচ্ছে। রিলায়েন্স ট্যানারির তত্ত্বাবধায়ক আল আমিনও জানান, চামড়ার সলিড ওয়েস্ট কূপ খনন করে রাখতে হচ্ছে। আজমেরি লেদারের মালিক শহিদ উল্লাহ সমকালকে জানান, গত বুধবার হাজারীবাগের তার কারখানা বন্ধ করে সেখানকার যন্ত্রপাতি সাভারে নিয়েছেন। এখন বিদ্যুৎ সংযোগের অপেক্ষায় আছেন। তার মতো বিভিন্ন ট্যানারি এক থেকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা জমা দিয়েছে। বিসিক সূত্রে জানা যায়, বিদ্যুতের জন্য আবেদন করা ১২৮টি ট্যানারির মধ্যে ৪০টির টাকা জমা পড়েছে। এর মধ্যে চারটি সংযোগ পেয়েছে। তা ছাড়া ১০২টি গ্যাসের জন্য এবং ৪৩টি পানির জন্য আবেদন করেছে। দুটিতে পানির সংযোগ দেওয়া হয়েছে।