গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে গণশুনানির দ্বিতীয় দিনেও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) তুমুল হইচই, বাকবিতণ্ডা ও হট্টগোল হয়েছে। বিক্ষুব্ধ অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে একপর্যায়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন খোদ বিইআরসি চেয়ারম্যান এআর খান। তার একটি বক্তব্যে অংশগ্রহণকারীরা একযোগে চেয়ার ছেড়ে উঠে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। তার বক্তব্য এক্সপাঞ্জের দাবি জানান। এতে দীর্ঘ সময় শুনানি বন্ধ থাকে। একপর্যায়ে চেয়ারম্যান তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে দুঃখ প্রকাশ করেন। পরিস্থিতি শান্ত হলে পুনরায় গণশুনানি শুরু হয়। সোমবার গণশুনানিতে তিতাস গ্যাস অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে ক্যাপটিভ পাওয়ারের দাম এক লাফে ১৩০ শতাংশ বৃদ্ধির তীব্র প্রতিবাদ জানান অংশগ্রহণকারীরা।
একই সঙ্গে তিতাস গ্যাসের আয় থেকে বিপুল অংকের টাকা সরকার ও পেট্রোবাংলা নিয়ে যাওয়ার তীব্র বিরোধিতা করেন। তাদের বক্তব্য, এ কারণে শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। পথের ভিখারি বনে গেছেন ৩০ লাখ বিনিয়োগকারী। শুনানিতে অংশগ্রহণকারীরা বলেন, গৃহস্থালি পর্যায়ে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কোনো ধরনের যুক্তি তিতাস গ্যাসের কাছে নেই। বর্তমানে ২৩ লাখ গৃহস্থালি গ্রাহক মাসে যে পরিমাণ গ্যাস খরচ করছে, তার চেয়ে বেশি দাম দিচ্ছে। তারপরও আবার গ্যাসের দাম বাড়ানো এক ধরনের প্রতারণা। গণশুনানি চলাকালে জেরার জবাবে এক পর্যায়ে বিব্রত হয়ে পড়েন দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবকারী তিতাস গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অংশগ্রহণকারীরা। ক্যাপটিভ ও গৃহস্থালিতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে এক পর্যায়ে তারা কোনো যুক্তি উপস্থাপনে ব্যর্থ হন।
শেষ পর্যন্ত তারা বলেন, সরকারের সিদ্ধান্তে তারা গৃহস্থালি খাতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে। এ সময় সরকারের সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত কাগজটি দেখতে চাইলে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ সেটাও দেখাতে পারেনি। সোমবার গণশুনানিতে অংশ নিয়ে টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা তপন চৌধুরী ও টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আবদুল মতিন বলেন, সরকার শিল্প-কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে না পারায় বাধ্য হয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা ক্যাপটিভ পাওয়ারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে শিল্প প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছিল।
কিন্তু ১১ মাসের মাথায় দ্বিতীয় দফায় ক্যাপটিভে গ্যাসের দাম ১৩০ শতাংশ বাড়ানো শিল্প প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের শামিল। এর আগে সেপ্টেম্বরেও ক্যাপটিভে গ্যাসের দাম ৪ টাকা ১৮ পয়সা থেকে এক লাফে ৮ টাকা ৩৬ পয়সা বৃদ্ধি করা হয়েছিল। এখন আবার ৮ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৯ দশমিক ২৬ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা করা হলে ২ থেকে ৩ হাজার শিল্প-কারখানা একযোগে বন্ধ হয়ে যাবে। লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে। তারা বলেন, সরকার ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ কেন্দ্র কুইক রেন্টাল চালাচ্ছে গ্যাস দিয়ে। অলাভজনক সার কারখানা চালাচ্ছে গ্যাস দিয়ে। কিন্তু যে শিল্প-কারখানা দেশের প্রাণ, সে শিল্পে ক্যাপটিভের অনুমোদন দিচ্ছে না। যারা এখনও ক্যাপটিভ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছেন, তারা যাতে সেটা করতে না পারেন সেজন্য এ খাতে গ্যাসের দাম এক লাফে ১৩০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।
আবদুল মতিন বলেন, ক্যাপটিভে হঠাৎ গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক বাড়লে ব্যবসা-বাণিজ্যে চরম মাত্রায় বিরূপ প্রভাব পড়বে। যেসব শিল্পমালিকরা এতদিন কিছুটা লাভের মুখ দেখে আসছিলেন, তাদের এখন লাভ তো দূরের কথা, লোকসানের কবলে পড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। যারা না লাভ, না লোকসানে আছেন ব্রেক ইভেন) তারা নির্ঘাত লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবেন। আর যারা লাভের আশায় লোকসান দিয়ে হলেও কোনোমতে শিল্প প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রেখেছেন, তাদেও কোনো গত্যন্তর থাকবে না। যে কোনো মুহূর্তে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে। এর ফলে দেশে আশংকাজনক হারে কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে। বেকার হয়ে যেতে পারে শ্রমিক-কর্মচারীদের একটি বড় অংশ। এ অবস্থায় তিনি অবিলম্বে ক্যাপটিভ প্লান্টে গ্যাসের দাম না বাড়ানোর জোর দাবি জানিয়েছেন।
এই টেক্সটাইল মিল মালিক সমিতির নেতা বলেন, তিতাস একটি কোম্পানি। কোম্পানিতে সব শ্রেণীর কর্মকর্তার হাতে নিজস্ব ক্ষমতা থাকার কথা। কিন্তু তিতাসের নিম্নস্তরের কর্মকর্তাদের হাতে কোনো ধরনের ক্ষমতা নেই। ছোটখাটো যে কোনো ফাইল ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে পাঠাতে হয়। এতে একটি ফাইল নিষ্পত্তিতে ৩-৪ মাস সময় লাগে। এটা করে তিতাস গ্যাস কোম্পানি ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে ফেলেছে। সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের হাতে দেয়া হয়েছে। এটা করে বড় ধরনের দুর্নীতি করা হচ্ছে। বর্তমানে তিতাসের জেনারেল ম্যানেজারদের হাতে কোনো ক্ষমতা নেই।
সাবেক উপদেষ্টা তপন চৌধুরী একটি উদহারণ দিয়ে বলেন, তার ফ্যাক্টরিতে একটি পুরনো মেশিন পরিবর্তন করে নতুন মেশিন লাগাবেন। কিন্তু গত তিন মাসেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এটা করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া আরও অনেক ক্ষমতা তিতাসের হাত থেকে অবৈধভাবে কেড়ে নেয়া হয়েছে। এভাবে দুর্নীতি লুটপাট করা হচ্ছে। তপন চৌধুরীর বক্তব্যের পর তিতাসের এমডি বলেন, ঢালাওভাবে এই বক্তব্য ঠিক নয়। নিচের লেভেল থেকে কোনো ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়নি। এটা সরকারের সিদ্ধান্ত। তিতাসের অনেক ফাইল আছে সেটা অনুমোদনের জন্য উপদেষ্টা পর্যন্ত পাঠাতে হয়। এছাড়া অনেক ফাইল আছে বোর্ডের অনুমোদন লাগে। এ সময় কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, এটিও ঠিক নয়। সব ধরনের ফাইল কেন ওপরে যাবে। অনেক কাজ নিচের লেভেলে মীমাংসা করতে হবে।
আবদুল মতিন বলেন, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাসের বরাদ্দ দেয়ার ক্ষেত্রে যে সমনীতি গ্রহণ করা উচিত ছিল, তা বাস্তবে করা হচ্ছে না। যাদের আগে গ্যাস সংযোগ পাওয়ার কথা, তারা পাচ্ছেন না। এ কারণেও অনেক সফল উদ্যোক্তা শিল্প বিকাশের লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে পড়ছেন। তিনি বলেন, চাহিদামাফিক নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা পেলে ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টের জন্য গ্যাস সংযোগ নিতে হতো না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায়ও রয়েছে নানা ত্রুটি। হঠাৎ করে ভোল্টেজ ওঠানামা করে। এতে প্রতিনিয়ত উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে। এর ফলে উৎপাদন ব্যাহত হওয়া ছাড়াও অনেক সময় মূল্যবান মেশিনারিজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব কারণে অনেকটা বাধ্য হয়েই ব্যবসয়ীরা ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করেন।
গণশুনানিতে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সংস্থা ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা সরদার রুহিন হোসেন প্রিন্স, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকি, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা ও বিএলআই সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন প্রমুখ। শামসুল আলম বলেন, তিতাসে বোর্ড মিটিংয়ের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। তিতাসের পরিচালনা পর্ষদ চেয়ারম্যান হলেন মন্ত্রণালয়ের সচিব। অধিকাংশ বোর্ড সদস্য সরকারের আমলা।
কাজেই এখানে সরকারের নির্দেশের বিরুদ্ধে কিছু করা সম্ভব নয়। সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী তিতাস গ্যাস গৃহস্থালি গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। এখানে তিতাসের কোনো দোষ নেই। তারা সরকারের নির্দেশ পালন করেছে মাত্র। তিনি তিতাসের পরিচালনা পর্ষদ চেয়ারম্যান তৃতীয় কাউকে করার দাবি জানান। মিনহাজ মান্নান ইমন তার বক্তব্যে বলেন, তিতাস গ্যাস কোম্পানি শেয়ারবাজারে একটি তালিকাভুক্ত কোম্পানি। প্রত্যেক তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে তাদের রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের আইন অনুযায়ী চলতে হয়। কিন্তু তিতাস কর্তৃপক্ষ এ আইনের কোনো তোয়াক্কা করে না। তিতাসের মুনাফার বড় একটি অংশ কমিশনকে না জানিয়ে সরকারের ফান্ডে দিয়ে দিচ্ছে। যার কারণে বছর শেষে বিনিয়োগকারীরা মুনাফা পাচ্ছে না। ৩শ’ টাকার শেয়ার ক্রয় করে ৩০ লাখ বিনিয়োগকারী এখন রাস্তার ভিখারি। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা চলে গেছেন। এ সময় কমিশন চেয়ারম্যান এআর খান বলেন, তিতাস গ্যাস কি শেয়ারবাজারের তথাকথিত বিনিয়োগকারীদের জন্য ডিভিডেন্ট দেবে? বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট অংকের বেশি মুনাফা দেয়া সম্ভব নয়। এ পর্যায়ে অংশগ্রহণকারীরা চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে তার কথার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তুমুল হইচই শুরু করেন। এক পর্যায়ে মিনহাজ মান্নান ফ্লোর নিয়ে চেয়ারম্যানকে ‘তথাকথিত’ শব্দটি এক্সপাঞ্জের দাবি জানান। এক পর্যায়ে চেয়ারম্যান দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, তিনি বিনিয়োগকারীদের তথাকথিত বলেননি। তিনি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের তথাকথিত বলেছেন।
তিতাস গ্যাসের বিতরণ চার্জ ২ পয়সা কমানোর সুপারিশ : দুপুরের বিরতির পর শুনানি শুরু হলে তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশনের বিতরণ চার্জ ২ পয়সা কমানোর সুপারিশ করেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের টেকনিক্যাল কমিটি। বর্তমান চার্জ দশমিক ২৩১ টাকা বা ২৩ পয়সা থেকে কমিয়ে দশমিক ০২১ টাকা বা ২১ পয়সা করার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে তিতাস চার্জ বাড়িয়ে ১ টাকা ০৩৮ পয়সা করার প্রস্তাব দিয়েছিল। সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানিটি আবাসিকে এক চুলার মাসিক বিল ৬শ’ টাকা থেকে ৮৩ শতাংশ বাড়িয়ে ১১শ’ টাকা, দুই চুলা ৬৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২শ’ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে। অন্যদিকে মিটারযুক্ত আবাসিক গ্রাহকদের ১৪০ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। এতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের মূল্য ৭ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ১৬ দশমিক ৮০ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে।