বছরের পর বছর নকল পণ্যের কাছে বাজার হারিয়ে বিলাসবহুল ব্র্যান্ডগুলো বহু বিলিয়ন ডলার খুইয়েছে। এবার ব্র্যান্ডগুলো সন্দেহভাজন নকলবাজদের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছে। দামি ব্র্যান্ড মালিকরা চীনসহ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বাজারে নকল পণ্য বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু মামলা করেছে। খবর ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।
বিলাসপণ্যের বাজারে নকলবাজি ঠেকানোর উপায় নিয়ে বহুদিন বিতর্ক চলেছে। সস্তা ও নকল পণ্যের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়তে গুচ্চি ও মনক্লারের মতো দামি ব্র্যান্ডগুলো এবার আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে। ই-কমার্স ও সোস্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে পণ্য বিপণন শুরুর পর থেকে নকলবাজদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্ববাজারে দামি ব্র্যান্ডের নকল পণ্যের বিস্ফোরক বিস্তার ঘটেছে।
ফ্যাশন ব্র্যান্ড আলেক্সান্ডার ওয়াং নকল হ্যান্ডব্যাগ, জুতা ও পোশাক বিক্রির অভিযোগে ৪৫৯টি ওয়েবসাইটের মালিকের বিরুদ্ধে গত বছর মামলা করেছিল। নিউইয়র্ক ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট এ মাসে মামলাটির রায় দিয়েছেন। আদালতের রায়ে আলেক্সান্ডার ওয়াং ৯ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। একই সঙ্গে আদালত অভিযুক্ত ওয়েবসাইটগুলোর ডোমেইন নেম আলেক্সান্ডার ওয়াংয়ের কাছে হস্তান্তর করেছেন। জব্দকৃত ওয়েবসাইটের সিংহভাগ চীনে উন্নয়ন করা হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এক বিবৃতিতে আলেক্সান্ডার ওয়াং আদালতের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি ব্র্যান্ডটি বৈশ্বিক স্তরে নিয়মিত নজরদারির মাধ্যমে নিজেকে সুরক্ষার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। নকলবাজদের বিরুদ্ধে চীনে দায়েরকৃত আধা ডজন মামলায় বিভিন্ন পশ্চিমা ব্র্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করছে স্কয়ার প্যাটন বগস। আইনি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানটির কনসালট্যান্ট পাওলো বেকোনচিনোর মতে, মামলা দায়েরের বিষয়টি দামি ব্র্যান্ডের অবস্থানে কৌশলগত পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী।
নকল পণ্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালালেও অতীতে অনেক ব্র্যান্ড বিষয়টি সেভাবে প্রকাশ করত না। অসাধু ম্যানুফ্যাকচারার ও বিক্রেতাদের ঠেকাতে অতীতে অনেক ব্র্যান্ড শুধু পুলিশি অভিযান ও মালামাল জব্দে জোর দিত। ফিলিপাইন, তাইওয়ান, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে বহুবার তল্লাশি অভিযান চালিয়ে এমন মালামাল জব্দের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বরাবরই নকলবাজরা আরো কুশলী হয়ে বাজারে ফিরে এসেছে। নকল পণ্যের উত্পাদন ও বিস্তার বেড়ে যাওয়ায় দামি ব্র্যান্ডগুলো অগত্যা আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছে। নকলবাজি বিরোধী সংস্থা ইউনিফ্যাবের মহাপরিচালক ডেলফিন সরফাতি-সব্রেইরা বলেন, অনলাইনে নকল পণ্যের বিস্তার এবং সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সঙ্গে নকলবাজদের সংযোগের কারণে দামি ব্র্যান্ডগুলো নকলবাজি ঠেকাতে আদালতে যাচ্ছে।
নকল পণ্যের বিক্রেতা শনাক্ত করা অনেক সময় কষ্টকর হয়ে ওঠে। এজন্য ব্র্যান্ডগুলো নকল পণ্য বিক্রেতা চিহ্নিত করতে তদন্তকারী ও আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে থাকে। স্কিনকেয়ার ও প্রসাধনী সামগ্রী বিক্রেতা লচিতান অঁ প্রোভেন্স অনলাইন বাজার থেকে নকল পণ্য সরাতে স্ট্র্যাটেজিক আইপি ইনফরমেশনকে নিয়োগ দিয়েছে। একই কাজের জন্য ইন্ডিটেক্স ও বিলাবং নেটনেমসকে নিয়োগ দিয়েছে। মার্কিন কর্তৃপক্ষ ২০১৪ সালে ১২০ কোটি ডলারের নকল পণ্য আটক করেছে। আটককৃত এসব পণ্যের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি চীনে প্রস্তুত করা হয়েছে।
নকল পণ্য ও মেধাস্বত্ব আইনের লঙ্ঘন ঠেকাতে চীন সরকার সে দেশের বড় শহরগুলোয় বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠা করেছে। নিউ অরলিন্সের তুলান ইউনিভার্সিটির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর মার্টিন দিমিত্রভ এ বিষয়ে এক গবেষণা করেছেন। তার তথ্য অনুযায়ী, মেধাস্বত্ব লঙ্ঘনের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা চীনে নয় বছরে নয় গুণ বেড়েছে। ২০১৪ সালে চীনে এমন মামলার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার, যা ২০০৫ সালে দায়েরকৃত মামলার ১০ গুণ। মার্টিন দিমিত্রভ জানিয়েছেন, ২০০৫-২০১৪ সময়কালে চীনে নকলবাজির অভিযোগে দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ১০ গুণ বেড়েছে। ২০০৫ সালে এমন মামলার সংখ্যা ছিল এক হাজারের কম। ২০১৪ সালে এমন মামলার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১১ হাজার।
দেশে দেশে মধ্যবিত্তের আকার বড় হচ্ছে। দামি ও বিলাসপণ্যের চাহিদাও বাড়ছে। এ অবস্থায় নকল পণ্য বড় ব্র্যান্ডগুলোর সুনাম ক্ষুণ্ন করবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন। ভালো মানের নকল পণ্য আসল পণ্য প্রস্তুতকারকের আয়ে ভাগ বসাবে, এ আশঙ্কাও রয়েছে। নকলবাজদের বিরুদ্ধে মামলায় আলেক্সান্ডার ওয়াংসহ কয়েকটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করছে ম্যাককার্টার অ্যান্ড ইংলিশ। প্রতিষ্ঠানটির পার্টনার হারলে লিউয়িন বলেন, সামান্য কিছু নকল পণ্য বাজারে বিক্রি হলে তা মেনে নেয়া সহজ। কিন্তু খুচরা বাজার যেহেতু এমনিতেই সঙ্কুচিত ও কঠিন হয়ে আসছে, তাই বিষয়টি ঠেকানো জরুরি হয়ে পড়েছে।
বিলাসপণ্য বিক্রেতা মনক্লারের লোগোসংবলিত পণ্য বিক্রি করত চীনের একটি কোম্পানি। ইতালির ব্র্যান্ডটি নভেম্বরে চীনা প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলায় জয়ী হয়েছে। নকল পণ্য বিক্রির অভিযোগে চীনের অনলাইন জায়ান্ট আলিবাবার বিরুদ্ধে মামলা করেছে মনক্লার, গুচ্চিসহ কয়েকটি ব্র্যান্ড। যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত চলতি মাসে মামলার অংশবিশেষ খারিজ করে দিয়ে বলেছেন, অভিযোগকারীরা নকল পণ্য বিক্রির জন্য আলিবাবা ও মার্চেন্টদের মধ্যে আঁতাতের প্রমাণ হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছেন। পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো আলিবাবার বিরুদ্ধে অনলাইনে নকল পণ্য বিক্রি উত্সাহিত করার অভিযোগ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আদালত এ অভিযোগ আমলে নিয়েছেন।