সরকারের রাজস্ব আয় নিয়ে বিভ্রান্তি বাড়ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কাগজে-কলমে যে আয় দেখাচ্ছে তার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। বিশাল অংকের ঘাটতির পরও এনবিআর দাবি করছে, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আয় বেশি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের দফতর এমনকি খোদ অর্থ মন্ত্রণালয়ের রাজস্ব আয়ের হিসাবের সঙ্গেও এনবিআরের তথ্যের মিল নেই। গত দুই অর্থবছরে মূল রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ৩৪ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। আর এই ব্যর্থতা লুকাতে এনবিআরের প্রস্তাবে নজিরবিহীনভাবে লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে।
অপরদিকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় তার প্রবৃদ্ধি ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ। কিন্তু বছর শেষে যে আয় দেখানো হয়েছে তার প্রবৃদ্ধি মাত্র ১৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। অর্থাৎ মূল লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক প্রবৃদ্ধি অর্জনেও ব্যর্থ হয়েছে এনবিআর। পাশাপাশি গত অর্থবছরে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি আড়াল করতে ২৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়। যা অস্বাভাবিক বলে জানিয়েছেন এনবিআরেরই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এতে সরকারের বাজেট বাস্তবায়নের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজস্ব আয়ের এ লক্ষ্যের ওপর নির্ভর করেই সরকারের জাতীয় বাজেট প্রণীত হয়। বছর শেষে যদি কাক্সিক্ষত পর্যায়ের রাজস্ব আয় না হয় তবে সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে বড় সংকটের সৃষ্টি হবে। এর বিরূপ প্রভাব পড়বে বাজেট বাস্তবায়নের ভারসাম্য রক্ষায়। অভ্যন্তরীণ আয় কমে গেলে ব্যয় কাটছাঁট করতে হয়। এতে সরকারের ঋণ-নির্ভরতা বেড়ে যায় এবং উন্নয়ন প্রকল্প কাটছাঁট করতে হয়। অর্থাৎ সরকারের আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য নষ্ট হয়। সরকারের আয়ের মূল উৎস রাজস্ব আয়। বৈদেশিক সহায়তা বা ঋণ কমে যাওয়ায় সরকারের রাজস্ব-নির্ভরতা বাড়ছে। কিন্তু ক্রমাগত রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থতা সরকারের পুরো বাজেট পরিকল্পনাকেই ওলটপালট করে দিচ্ছে।
এনবিআরের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র দাবি করছে, সরকারের রাজস্ব আদায় নিয়ে অরাজকতা চলছে। সব ক্ষেত্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চরম ক্ষোভ আর অসন্তোষ নিয়ে কাজ করছেন। কথায় কথায় হয়রানি, হুমকি-ধমকি, ভালো কাজের মূল্যায়ন না করা, যথাযথ তদারকি ও পরিকল্পনা ছাড়াই রাজস্ব আদায়, পারস্পরিক সমন্বয়ের অভাব এবং শীর্ষ পর্যায়ের অযোগ্যতা, অদক্ষতা এ জন্য দায়ী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের সাবেক এক চেয়ারম্যান বলেন, করবান্ধব পরিবেশ ছাড়া যথাযথ রাজস্ব আয় সম্ভব নয়। যারা কর আদায় করবেন তাদের মধ্যে অসন্তোষ, হতাশা থাকলে প্রকৃত রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে না। রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এনবিআরের শীর্ষ পর্যায়ে সমন্বয় না থাকলে, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে দলাদলি থাকলে রাজস্ব আয়ে বিরূপ প্রভাব পড়বে এটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে এনবিআরের চেয়ারম্যানের দূরত্ব বা সমন্বয়হীনতা থাকলে তা পুরো রাজস্ব প্রশাসনের ওপরই প্রভাব ফেলে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, রাজস্ব আদায় করতে না পারাটা এনবিআরের ব্যর্থতা। এর বাইরে আর কোনো শব্দ নেই। তার মতে, এনবিআরের চেয়ারম্যান যাকে বানানো হল, তিনি নিজের ঘরের বাজেট সঠিক হিসাব করতে পারবেন না, এটি গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট তিনটি কারণে রাজস্ব আদায় ব্যর্থ হয়। প্রথমত. যদি উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়, তবে আদায় সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে এনবিআরের ব্যর্থতা রয়েছে। এনবিআর যদি বলে উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, এটি যুক্তিসঙ্গত হবে না। কারণ সরকার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা একদিনে ঠিক করে না। এ জন্য অনেকগুলো বৈঠক হয়। ওইসব বৈঠকে এনবিআরের চেয়ারম্যানের মতামত চাওয়া হয়। ওই মতামতের ভিত্তিতে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। দ্বিতীয় কারণ হল, কোন খাত থেকে কী পরিমাণ রাজস্ব আসবে তার সঠিক হিসাব করতে পারেনি এনবিআর। তৃতীয় কারণ হল, হিসাব সঠিক থাকলেও রাজস্ব আদায়ে এনবিআরের মেকানিজমগুলো (কৌশল) ব্যর্থ হয়েছে। বদিউর রহমান বলেন, এখানে কেউ কেউ একটি ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যবসা-বাণিজ্য কমে গেছে। কিন্তু এটি ঠিক নয়। গত এক বছরে দেশে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত ছিল। এরপরও রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়াটা যৌক্তিক নয়। এ ছাড়া সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা আদায় করতে সক্ষম হলেও তাতে থেকে যাচ্ছে নানা প্রশ্ন। রাজস্ব আয়ের প্রকৃত পরিমাণ নিয়ে এনবিআরের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয় ও মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের (সিজিএ) তথ্যের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক গরমিল। বলা হচ্ছে, বছর শেষে ব্যর্থতা ঢাকতে এনবিআর কাগজে-কলমে রাজস্ব আয় ফুলিয়ে-ফাঁফিয়ে দেখাচ্ছে। কমিশনারদের পাঠানো তথ্যের সত্যতা যাচাই না করেই তা আমলে নেয়া হচ্ছে। এ জন্য অনেক কমিশনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারলেও বেশি রাজস্ব আয়ের কৃতিত্ব নেন। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যের সঙ্গে বা সিজিএ তথ্যের সঙ্গে এনবিআরের রাজস্ব আয়ের তথ্য মিলছে না। সিজিএ আপত্তি জানিয়ে বলছে, সরকারের কোষাগারে ৩০ জুন পর্যন্ত জমা হওয়া রাজস্ব আদায়ের হেডের যে তথ্য তার সঙ্গে এনবিআরের দাবি অনেক বেশি। যা অযৌক্তিক।
সূত্রমতে, রাজস্ব আদায়ে নজিরবিহীন ঘাটতির মুখে সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে ২৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়। যা মোট লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ১৫ শতাংশ। অতীতে আর কখনও এক বছরে এত বিরাট অংকের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়নি। মূলত নজিরবিহীন ঘাটতি সামাল দেয়ার লক্ষ্যেই এভাবে পরিকল্পনাহীন লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। আর এ পদক্ষেপের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সরকারের বাজেট বাস্তবায়নে। এ ছাড়া গত অর্থবছরে ২১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি ছিল। কিন্তু এ ব্যর্থতা ঢাকতে শেষ সময়ে এনবিআরের প্রস্তাবে লক্ষ্যমাত্রা থেকে কমানো হয়। এরপরই এনবিআর দাবি করে- অতিরিক্ত সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। যা গতিশীল নেতৃত্বের সাফল্য। এর আগের বছরও রাজস্ব ঘাটতি ঢাকতে লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয় ১৪ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা। এভাবে গত দুই অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে ৪১ হাজার ৬২ কোটি টাকা। অথচ এনবিআরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের আগের বছরগুলোতে লক্ষ্যমাত্রা কাটছাঁটের একটি ভারসাম্য ছিল। এর মধ্যে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয় ১১ হাজার ৯০ কোটি টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়নি। এর আগে ২০১১-১২ অর্থবছরে কমানোর পরিবর্তে উল্টো ৫০০ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। এ চিত্রই বলে দেয় রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থতা ঢাকতে অপকৌশলের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। পরবর্তী বছরগুলোতে হঠাৎ এক লাফে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই বিশাল অংকের লক্ষ্যমাত্রা কাটছাঁট রাজস্ব আদায়ের শৃংখলা নষ্ট করছে বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। যা জাতীয় সংসদ অনুমোদিত। কিন্তু বছরের শেষ সময়ে এসে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয়। লক্ষ্যমাত্রা কমানোর হার ১৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ। জুন শেষে এনবিআর দাবি করেছে, গত অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয় হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বেশি। আগের বছরের তুলনায় আদায়ের প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। এনবিআরের এ দাবিকে হাস্যকর উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির মূল রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মাত্র সাড়ে ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির রাজস্ব আদায়ের দাবি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার শামিল। সরকারের উচিত প্রকৃত বিষয় মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। আর তা নাহলে উচ্চ প্রবৃদ্ধির রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে নিু প্রবৃদ্ধির রাজস্ব আয় স্বীকৃতি পেলে রাজস্ব আদায়ে খারাপ প্রভাব পড়বে। বেশি রাজস্ব আদায়ে কর্মকর্তারাও নিরুৎসাহিত হবেন। অপরদিকে এর আগের ২০১৪-১৫ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৪৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। আয়ের প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ২৪ শতাংশ। কিন্তু এ বছরও ব্যাপক ঘাটতির মুখে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ কমানো হয়। কিন্তু বছর শেষে আদায় হয় ১ লাখ ৩৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। আদায়ের প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১২ দশমিক ৩১ শতাংশ। মূল লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা।
মজার বিষয় হচ্ছে, মূল্য লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি ছিল। তারপরও সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৫ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করেছে বলে দাবি করছে এনবিআর। মামলা ও অন্যান্য খাত থেকে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার পাওনা বকেয়া রাজস্ব যোগ করে এনবিআর এই তথ্য প্রকাশ করেছে। অথচ বকেয়া রাজস্ব দীর্ঘদিন থেকে পুঞ্জীভূত। আবার দীর্ঘদিন মামলা লড়ে রায় সরকারের পক্ষে আসায় আদায় করা হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব। এর সঙ্গে লক্ষ্যমাত্রা সম্পর্কিত না হলেও এই অর্থ যোগ হচ্ছে রাজস্ব আয়ের সঙ্গে। আগের বছরগুলোর বকেয়া রাজস্ব বা মামলায় আটকে থাকা রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রায় নির্ধারিত রাজস্বের সঙ্গে এক করা যৌক্তিক নয় এবং অনৈতিক বলে দাবি করছে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞমহল।