এশিয়ার বড় অর্থনীতিগুলোর সিংহভাগ ভোক্তা ঋণের ভারে শ্লথ হয়ে পড়ছে। এ অঞ্চলের আটটি দেশে ভোক্তা ঋণের আকার জিডিপির তিন-চতুর্থাংশের বেশি। এ কারণে অর্থনীতিকে প্রণোদনা দিতে সুদহার হ্রাসের মতো পদক্ষেপ নিলেও তা খুব একটা কাজে আসছে না। কেননা সিংহভাগ ভোক্তা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নতুন ঋণগ্রহণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। খবর রয়টার্স।
থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলীয় নং বুয়া লামফু প্রদেশে কর্মরত পুয়াংপেত উরাবাত। ৪০ বছর বয়সী এ সরকারি কর্মচারীকে থাই ভোক্তাদের প্রতিভূ বলা যায়। গলা পর্যন্ত ঋণে ডুবে আছেন তিনি। দিনযাপনের মৌলিক ব্যয় মেটাতে তিনি ঋণ নিচ্ছেন আগামী মাসগুলোর বেতনের বিপরীতে। পুয়াংপেত উরাবাতের মাসিক বেতন ২৫ হাজার বাথ (৭১৮ ডলার)। চারটি ক্রেডিট কার্ডে তার দেনার পরিমাণ আড়াই লাখ বাথ। এছাড়া কার লোন নিয়েছেন ৩ লাখ বাথ। কখনো কখনো একটি ক্রেডিট কার্ড সার্ভিসিংয়ের প্রয়োজনে তিনি আরেকটি থেকে নগদ অর্থ উত্তোলন করেন। পুয়াংপেতের মতো ভোক্তারা বছরের পর বছর ঋণের বলে বলীয়ান হয়ে দুহাত খুলে অর্থ ব্যয় করেছেন। এশিয়ার ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিগুলোকে তারাই শক্তি জুগিয়েছেন। কিন্তু এবার তারা নিজেদের
দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য বোঝা হয়ে পড়েছেন। সুদের হার যতই হ্রাস পাক না কেন, এ বোঝা হালকা হওয়ার নয়। বিশ্বজুড়ে সুদহার এখন সর্বনিম্ন স্তরে। কিন্তু ভোক্তা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো এরই মধ্যে এত ঋণগ্রস্ত হয়ে আছে যে, নতুন করে তাদের ঋণ নেয়ার ক্ষমতা নেই। গত মাসে সাংহাইয়ে বৈঠকে মিলিত হওয়া গ্রুপ অব টোয়েন্টির (জি২০) অর্থমন্ত্রীরা বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন। এজন্যই তারা বলেছেন, ‘মুদ্রানীতির একার পক্ষে সুষম প্রবৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব নয়।’
বৈশ্বিক আর্থিক সংকট সামাল দিতে বড় অর্থনীতির দেশগুলো সাত বছর ধরে নতুন নোট ছাপিয়েছে ও বারবার সুদহার কমিয়েছে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোয় তখন সুদহার উন্নত বিশ্বের চেয়ে বেশি ছিল। এ কারণে উদীয়মান দেশগুলোর অর্থবাজারে বানের জলের মতো তারল্য এসেছে। পরিণামে এসব দেশে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ঋণ নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। ব্যাংক অব থাইল্যান্ডের (বিওটি) নীতিনির্ধারকরা সমস্যাটি বোঝেন। এজন্যই তারা ১৬ মাস ধরে রেকর্ড নিম্নতম সুদহার বহাল রেখেছেন। মূল্যস্ফীতি ও চাহিদা কমে যাওয়া সত্ত্বেও সুদহার বৃদ্ধি করা হয়নি। বিওটি গভর্নর বীরাথাই শান্তিপ্রাভব বলেন, ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে প্রণোদিত করতে মুদ্রানীতি যা করতে পারে, তার কিছু সীমা রয়েছে।’
এইচএসবিসির তথ্য অনুযায়ী, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বৃহত্তম ১৪ অর্থনীতির মধ্যে আটটিতেই ভোক্তা ঋণের পরিমাণ জিডিপির তিন-চতুর্থাংশের বেশি। এইচএসবিসির ইকোনমিক রিসার্চ বিভাগের সহ-প্রধান ফ্রেডেরিক ন্যুম্যান বলেন, ‘এ কারণেই নীতিনির্ধারকরা সুদহার আরো হ্রাসের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে উঠেছেন।’ ন্যুম্যান আরো বলেন, ‘সুদহার হ্রাস করলেও ভোক্তা ব্যয়ে আগের মতো গতি সঞ্চার হবে না। কেননা বেশির ভাগ ভোক্তা আর টাকা দেখে তালি দেয়ার মতো অবস্থায় নেই।’
জিডিপির বিপরীতে সার্বিক ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে এশিয়ার বেশির ভাগ দেশের। ২০০৮ সালের পর ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে চীন, হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও জাপানের। কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় ঋণ-জিডিপি অনুপাত ২৫০ শতাংশের মতো। চীন, হংকং ও সিঙ্গাপুরে এ অনুপাত আরো বেশি।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) শুক্রবার চীনের অর্থনীতি নিয়ে নিজেদের বার্ষিক পর্যালোচনা প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি চীনকে সময় থাকতে করপোরেট ঋণ কমানোর পরামর্শ দিয়েছে। চীন ছাড়া এশিয়ার অন্যান্য দেশে সার্বিক ঋণ এখনো অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে ওঠেনি। কিন্তু উঁচু মাত্রার ভোক্তা ঋণ এসব দেশের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মুদ্রানীতি শিথিল করলে এ ঝুঁকি আরো সামনে চলে আসবে।
মার্চের শেষ নাগাদ কোরীয় পরিবারগুলোর ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ কোটি ডলার। সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাই শ্লথ হয়ে পড়া অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করতে আর্থিক নীতির শরণাপন্ন হতে বলেছে। সরকারকে সে পথে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ব্যাংক অব কোরিয়া বলেছে, নতুন সুদহার হ্রাস শুধু অকার্যকর নয়, বরং এতে ঝুঁকি রয়েছে।
বিওটি গত মাসে নতুন করে সুদহারে হাত দেয়নি। ব্যাংক অব কোরিয়াও তা-ই করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী, কোরিয়া সরকার ২০ ট্রিলিয়ন ওনের (১ হাজার ৮১৯ কোটি ডলার) বিরাট আর্থিক প্রণোদনা হাজির করেছে। প্রতিবেশী মালয়েশিয়া সুদহার কমিয়ে অর্থনীতিবিদদের অবাক করেছে।
ওসিবিসি ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ ওয়েলিয়ান বিরান্তো বলেন, মালয়েশিয়া হচ্ছে সেসব মুষ্টিমেয় দেশের একটি, যাদের এখনো সুদহার কমানোর সামান্য সুযোগ রয়েছে। তবে এ ব্যবস্থার কার্যকারিতা যে কমে আসছে, বিরান্তো তা স্বীকার করেন। তার আশঙ্কা, গেরস্থালি ঋণের পাহাড় আরো বহুদিন এমন উঁচু থাকবে।