আটলান্টিক মহাসাগরের অন্য পাড়ের দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সম্ভাব্য দুটি ভিন্ন বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে জার্মানিতে তীব্র অসন্তোষ দানা বেঁধেছে। চরম আবহাওয়া উপেক্ষা করে শনিবার দেশটির সাতটি শহরজুড়ে দেড় লাখের বেশি মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। তাদের কণ্ঠে ছিল ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার স্লোগান। হাতে ছিল চুক্তিবিরোধী ব্যানার। সবার দাবি একটাই, ইইউভুক্ত দেশগুলোর স্বকীয়তা ও ঐতিহ্য বিসর্জন দিয়ে কোনো বাণিজ্য চুক্তি করা যাবে না। খবর বিবিসি ও এএফপি।
২০১৩ সাল থেকে ট্রান্সআটলান্টিক ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পার্টনারশিপ (টিটিআইপি) বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আলোচনা করে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পথে প্রধান অন্তরায়গুলো দূর করার মাধ্যমে প্রায় ৮৫ কোটি ভোক্তা নিয়ে বিশ্বের সর্ববৃহত্ মুক্ত বাণিজ্যের বাজার তৈরিই টিটিআইপির মূল লক্ষ্য। তবে চুক্তিটির বিরোধী পক্ষ দাবি করছে, এর মাধ্যমে খাদ্য ও পরিবেশ সুরক্ষা-সংক্রান্ত ইউরোপীয় মানদণ্ড ধরে রাখা সম্ভব হবে না। এছাড়া চুক্তিটির ফলে আউটসোর্সিংয়ের পরিধি ও বেকারত্বের হারও বেড়ে যাবে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।
আগামী বছরের জানুয়ারিতে নিজের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই টিটিআইপি চুক্তি চূড়ান্ত করতে চান মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। এ লক্ষ্যে দুই পক্ষ আলোচনার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় অক্টোবরে নতুন দফায় আলোচনায় বসবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ। দুই পক্ষই বর্তমানে বেশির ভাগ বাণিজ্যিক শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য কাজ করছে। তবে খোদ ইউরোপেই টিটিআইপি নিয়ে বিক্ষোভ দানা বেঁধেছে। শুধু বেসামরিক নাগরিকরাই যে এর প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছেন, তা নয়। বরং কয়েকটি দেশের সরকারও প্রস্তাবিত চুক্তিটির বিরোধিতা করেছে। ফরাসি সরকার এর বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ চূড়ান্ত চুক্তির ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেছেন। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল এর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করলেও দেশটির অর্থমন্ত্রী সিগমার গ্যাব্রিয়েল মনে করেন, বাস্তবিক অর্থে টিটিআইপি আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে।
শনিবার জার্মানির বিরূপ আবহাওয়াও যেন টিটিআইপির প্রতি সাধারণ জনগণের মনোভাব সমর্থন করেছে। তীব্র শীত ও আর্দ্র আবহাওয়াকে প্রতিকূলতার প্রতীকী চিত্র হিসেবে দেখা যেতে পারে। এদিন বার্লিন, মিউনিখ, হামবুর্গ ও ফ্রাংকফুর্টসহ জার্মানির সাতটি শহরের রাস্তায় নেমে আসা ১ লাখ ৬০ হাজারের বেশি মানুষের মধ্যে প্রতিবাদী মনোভাব লক্ষ করা গেছে। বাস্তুশৃঙ্খল লঙ্ঘনে প্রকৃতি যেমন বিরূপ হয়ে ওঠে, তেমনি জার্মানরা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, নিজেদের স্বার্থের ক্ষতি করে তারা কোনোমতেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হতে দেবেন না। বিক্ষোভকারীদের অনেকে আশঙ্কা করছেন, টিটিআইপি বাস্তবায়িত হলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আটলান্টিকের দুই পাড়ের অধিবাসীকে শোষণ করবে। বার্লিনে বিক্ষোভে যোগ দেয়া পিটার ক্লজিং বলেন, ‘আমি টিটিআইপি থেকে মুক্তি চাই। ইউরোপীয় সামাজিক ও পরিবেশগত মানদণ্ডের প্রতি আপনার অবশ্যই শ্রদ্ধা থাকতে হবে। আমি চাই, এ মানদণ্ড ধরে রাখা হোক ও এর উন্নয়ন ঘটানো হোক।’
শুধু যে টিটিআইপি নিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে, তা নয়। কানাডার সঙ্গে ইইউর অনুরূপ একটি চুক্তি নিয়েও জার্মানরা তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছেন। আগামী অক্টোবরে দুই পক্ষের মধ্যে কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক ট্রেড এগ্রিমেন্ট (সিইটিএ) স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা রয়েছে। রফতানিকারকরা মনে করছেন, চুক্তিটির ফলে শুল্ক কমে যাবে, লাল ফিতার দৌরাত্ম্য দূর হবে ও ভোক্তাবাজারের পরিধি বিস্তৃত হবে। এ কারণে তারা চুক্তিটিকে সমর্থন করেছেন। তবে ইউরোপের ভোক্তারা আশঙ্কা করছেন, চুক্তিটি ইইউর শ্রমবাজার ও পরিবেশগত মানদণ্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে। ফলে আঞ্চলিক জোটটির বেশকিছু বিধিবিধান স্বকীয়তা হারাবে।
এছাড়া মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আওতায় একটি বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করা হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন দেশের সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কোম্পানিগুলোর দায়ের করা মামলার শুনানি হবে। বিক্ষোভকারীরা আশঙ্কা করছেন, এর মাধ্যমে কোম্পানিগুলোকে সরকারি নীতির বিরুদ্ধে ভেটো প্রদানের ক্ষমতা দেয়া হবে। তবে সমর্থনকারীরা চুক্তি দুটির ব্যাপারে উদ্বেগের কিছু দেখছেন না। তারা দাবি করছেন, এগুলোর মাধ্যমে বাণিজ্য শুল্ক কমে যাবে এবং প্রবৃদ্ধি জোরদার হবে।