মুক্তবাজারের বিরুদ্ধে জনমতের উত্তুঙ্গ সময়ে অবাধ বাণিজ্যকে বাঁচানোর প্রত্যয়ে চীনের হ্যাংঝৌতে শেষ হয়েছে গ্রুপ অব টোয়েন্টি (জি২০) ফোরামের শীর্ষ সম্মেলন। বিশ্বের শীর্ষ ২০ অর্থনীতির নেতারা মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে প্রবৃদ্ধিকে সামুদয়িক রূপ দেয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। খবর ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও রয়টার্স।
বিশ্বজুড়ে জনমতে মুক্ত বাজারবিরোধী ঢেউ দেখা যাচ্ছে। ব্রিটেনের নাগরিকরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি বলবত্করণের পথ রুদ্ধ হয়ে আসছে। জি২০ সম্মেলনে বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় বৈঠকগুলোয় নেতারা তাই মুক্ত বাণিজ্যের প্রতি সমর্থন সৃষ্টি করতে নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নের গুরুত্বের কথা বারবার বলেছেন। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী টেরিসা মে বলেছেন, ‘বিশ্বকে নিশ্চিত করতে হবে, যাতে মুক্ত বাণিজ্যের ফলে সৃষ্ট সুযোগগুলো শ্রমজীবী মানুষের সত্যিকার কাজে আসে।’ সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্টিন লাগার্দের মন্তব্যে মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থাকে বাঁচানোর মূলমন্ত্র উঠে এসেছে। আইএমএফ প্রধান ক্রিস্টিন লাগার্দে বলেছেন, ‘আরো প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে এবং প্রবৃদ্ধি অবশ্যই সামুদয়িক হতে হবে।’ বিশ্বায়ন প্রসেঙ্গ ক্রিস্টিন লাগার্দে বলেন, ‘বিশ্বায়ন শুধু মুষ্টিমেয় মানুষ নয়, সবার উপকারে আসা চাই।’
জি২০ নেতাদের যৌথ ঘোষণায় ‘প্রবৃদ্ধিকে সামুদয়িক রূপ দেয়ার’ কথা বলা হয়, যাতে ‘আরো মানসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, বৈষম্য ও দারিদ্র্য দূর হয় এবং কেউ পিছিয়ে না থাকে।’ প্যারিসভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের সেক্রেটারি জেনারেল জন ডানিলোভিচ বলেছেন, ‘জি২০-এর বিশ্লেষণের সঙ্গে আমরাও একমত যে, বাণিজ্য ও মুক্ত বাজারের সুফল আরো কার্যকরভাবে বৃহত্তর জনসমাজের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।’ সংরক্ষণবাদী কৌশল ঠেকানো ও দেশীয় মুদ্রার প্রতিযোগিতামূলক অবমূল্যায়ন না করার ঘোষণাকে এবারের সম্মেলনের সাফল্য বলা যায়। কিন্তু প্রবৃদ্ধি জোরদার ও অতিরিক্ত উত্পাদন সক্ষমতা হ্রাসে কর্মপন্থা নির্ধারণের বিষয়টি অধরা রয়ে গেছে।
দুদিনের শীর্ষ সম্মেলন শেষে জি২০ ফোরামের পক্ষ থেকে সোমবার সন্ধ্যায় নয় পৃষ্ঠার বিবৃতি দেয়া হয়। এতে শীর্ষ ২০ অর্থনীতির নীতিনির্ধারকরা বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি জোরদারে নতুন হাতিয়ার ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু ওই হাতিয়ার কি হবে এবং তা কীভাবে কাজ করবে, সে ব্যাপারে চীনে নির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা আসেনি। জি২০ নেতারা স্বীকার করেছেন, বৈশ্বিক অর্থনীতিকে টেনে তুলতে সুদহার কম রাখাই যথেষ্ট নয়। এজন্য প্রয়োজনে অর্থনীতির কাঠামো ও খোলনলচে পাল্টে ফেলার সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখতে হবে।
জি২০ ফোরামের রুদ্ধদ্বার বৈঠকগুলোয় বিশ্ববাজারে ইস্পাত পণ্যের অতি সরবরাহ নিয়ে চীনকে চাপে পড়তে হয়েছে। ইউরোপের এক কর্মকতা বলেছেন, জি২০ নেতাদের যৌথ ঘোষণার খসড়ায় চীনের অতিরিক্ত ইস্পাত উত্পাদন সক্ষমতার উল্লেখ থাকায় চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। স্বাগতিক দেশ চীন বিষয়টি ভালোভাবেই সামলে নিয়েছে। জি২০ নেতাদের চূড়ান্ত ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘আমরা স্বীকার করছি যে, ইস্পাত ও অন্যান্য শিল্পে অতি সক্ষমতা একটি বৈশ্বিক ইস্যু, যাতে সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।’
ইস্পাতপণ্যের অতিরিক্ত উত্পাদন পর্যবেক্ষণে জি২০ ফোরাম একটি বৈশ্বিক কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে। একজন ইউরোপীয় কর্মকর্তা বিষয়টিকে জি২০ সম্মেলনে ইউরোপের প্রধান প্রাপ্তি বলে অভিহিত করেছেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরিসা মের কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, কয়েকটি দেশের বাধা সত্ত্বেও আমরা চূড়ান্ত ঘোষণায় (অতি সক্ষমতা হ্রাসের) গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু কথা উল্লেখ করতে পেরেছি।
এছাড়া জি২০ নেতাদের যৌথ ঘোষণায় আর্থিক বাজারের অস্থিতিশীলতা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মন্দাভাব এবং কমোডিটি পণ্যের মূল্য পতনশীল থাকার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি কার্যকরের বিষয়ে এবারের জি২০ সম্মেলনে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র একটি যৌথ ঘোষণা দিয়েছে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণকারী দুটি দেশের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। শরণার্থী ও অভিবাসন সমস্যার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে বিরাট সংখ্যক মানুষের বাধ্যতামূলক বাস্তুচ্যুতি একটি বৈশ্বিক উদ্বেগের বিষয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক হ্যাংঝৌতে বলেছেন, ইউরোপের শরণার্থী গ্রহণের সক্ষমতা শেষ হয়ে আসছে।