ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী কারিমা সুলতানা। কলেজে অধ্যয়নের সময়ই বোরকা ও হিজাব পরা শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়েও নিয়মিত বোরকা-হিজাব পরছেন। পরিবার কিংবা ধর্মীয় কারণে নয়, অনেকটা ভালো লাগা থেকেই পোশাকটি পরছেন বলে জানান কারিমা। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, দেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সী নারীদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ বোরকা ও হিজাব পরিধান করছে। এর মধ্যে গ্রামীণ নারীদের প্রায় ৫০ শতাংশ পোশাকটি পরছেন। শহুরে নারীদের মধ্যে এ হার কিছুটা কম। তবে তা ৩০ শতাংশের নিচে নয়। অঞ্চলভেদেও হিজাব ও বোরকা পরার প্রবণতায় তারতম্য রয়েছে। সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রায় ৭০ শতাংশ নারীই বোরকা বা হিজাব পরিধান করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিশেষ কিছু জেলা, যেমন— নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনীতে ১৫ বছরের বেশি বয়সী প্রায় ৮০ শতাংশ নারীই বোরকা ও হিজাব পরেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, দেশে নারীর সংখ্যা ৭ কোটি ৯৩ লাখ। এর মধ্যে ১৫ বছরের বেশি বয়সী নারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি।
বিবিএসের এ পরিসংখ্যান ও গবেষণার তথ্য বিবেচনায় দেশে বোরকা ও হিজাব ব্যবহারকারী নারীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ। এ পোশাক বাবদ একজন নারী বছরে গড়ে ১ হাজার টাকা ব্যয় করলেও দেশে বোরকা ও হিজাবের বাজার দাঁড়ায় ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। রাজধানীর অভিজাত শপিংমল বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স ঘুরে দেখা যায়, এ মার্কেটে একশর মতো হিজাব ও বোরকার দোকান রয়েছে। শুধু হিজাব বিক্রি করে এমন দোকানও রয়েছে। এসব দোকানে হিজাব ও বোরকা বিক্রি হয় প্রতিদিন গড়ে ১৫-২০ হাজার টাকার। এ হিসাবে কেবল বসুন্ধরা মার্কেটেই বোরকা ও হিজাব বিক্রি হয় বছরে ৫০-৬০ কোটি টাকার।
বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সই শুধু নয়, রাজধানীর নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড ও কাঁটাবন এলাকায়ও দেড় শতাধিক হিজাব ও বোরকার দোকান রয়েছে। হিজাব ও বোরকার শোরুম গড়ে উঠেছে গুলশান, বনানী ও উত্তরা এলাকায়। ফুটপাতের দোকানগুলোয়ও হিজাবের স্টল চোখে পড়ার মতো। অনলাইন শপগুলোরও চাহিদাসম্পন্ন পোশাকের তালিকায় রয়েছে হিজাব ও বোরকা। বর্তমানে দেশে শতাধিক ই-কমার্স সাইট রয়েছে। কিছু পোর্টাল রয়েছে, যেগুলোয় শুধু হিজাব ও বোরকা বিক্রি হয়। এছাড়া ফেসবুকভিত্তিক (এফ-কমার্স) সাইটও রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— হিজাব আইকন, হিজাব শপ, আহাম হিজাব কালেকশন ও হিজাব হাউজ। ই-কমার্স সাইটের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— আজকের ডিল, আবায়া ক্লদিং, সিনবাদ ডটকম ও ডিঅ্যান্ডজি।
দেশে হিজাব ও বোরকা বিক্রয়কারী অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ‘ইরানী বোরকা বাজার’। ২০০৭ সালের দিকে বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে মাত্র দুটি দোকান দিয়ে যাত্রা করে প্রতিষ্ঠানটি। নয় বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির শাখা দাঁড়িয়েছে ২৮টি। ঢাকার বাইরেও নিজস্ব শাখা খুলে হিজাব ও বোরকা বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। ইরানী বোরকা বাজার লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলী বণিক বার্তাকে বলেন, স্বল্প পরিসরে আমরা ব্যবসা শুরু করি। দেশে হিজাব-বোরকার চাহিদা বেড়েছে। বিশেষ করে কম বয়সী নারীদের মধ্যে হিজাব-বোরকা এখন ফ্যাশনেবল পোশাক হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন জেলায় আমরা নতুন শাখা খুলেছি। ক্রেতার চাহিদা মাথায় রেখে প্রতিনিয়ত নতুন ডিজাইনের হিজাব-বোরকা বাজারে আনছি।
রাজধানীর আরেক অভিজাত শপিংমল যমুনা ফিউচার পার্ক ঘুরে দেখা যায়, সেখানেও হিজাব ও বোরকার বেশ কয়েকটি শোরুম গড়ে উঠেছে। যমুনা ফিউচার পার্কের এক বোরকা বিক্রেতা জানান, ক্রেতাদের চাহিদার শীর্ষে রয়েছে স্টাইলিশ ফ্যাশনেবল হিজাব ও বোরকা। ক্রেতার চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে তারাও আধুনিক ডিজাইনের হিজাব ও বোরকা বিক্রি করছেন। এর মধ্যে রয়েছে কটি স্টাইল, অ্যারাবিয়ান স্টাইল, কাপতান, ওয়ান পার্ট, টু পার্ট, থ্রি পার্টসহ নানা ডিজাইনের বোরকা। হিজাবেরও রয়েছে নানা ধরন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— এম্ব্রয়ডারি হিজাব, ক্যাপ হিজাব, ম্যাক্সি হিজাব, গ্লিটার হিজাব ও জিগজ্যাগ গ্লিটার হিজাব। এসব হিজাব ও বোরকার সঙ্গে বিক্রি হচ্ছে ইনার ক্যাপ, স্কার্ফ, ওড়না, হিজাব পিনসহ নানা সামগ্রীও।
হিজাব ও বোরকার চাহিদা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড. সানজীদা আখতার বলেন, বর্তমানে পোশাকের বাজারে ধর্মীয় অনুপ্রেরণা ও আধুনিক ফ্যাশনের মধ্যে একটি সংযোগ ঘটানো হয়েছে। হিজাব ও বোরকা পরিধানকারী নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি কারণ হতে পারে। আমাদের দেশের নারীরা ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় পর্দার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। পাশাপাশি আধুনিক ফ্যাশনও পছন্দ করে। বর্তমান সময়কার বাজারে হিজাব ও বোরকার ডিজাইনে আধুনিক ফ্যাশনের ছোঁয়া লেগেছে। ফলে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
বাংলাদেশী নারী, বিশেষ করে তরুণীদের মধ্যে হিজাব ও বোরকার প্রতি ঝোঁকের বিষয়টি উঠে এসেছে বিভিন্ন গবেষণায়ও। যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক বাংলাদেশী ফাতেমা মোহসিনা ইসলাম গবেষণা করেছেন বাংলাদেশী তরুণীদের ইসলামী ফ্যাশন ও পোশাক নিয়ে। ‘আ কনসেপচুয়াল ফ্রেমওয়ার্ক অন দ্য স্টাডি অব ট্রেন্ডস অব ইসলামিক ফ্যাশন অ্যান্ড ক্লদিং প্র্যাকটিসেস অ্যামোংস্ট ইয়াং মুসলিম ফিমেল ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন, ৫৬ শতাংশ তরুণীই ইসলামী পোশাক পরিধান করেন।
২০১২ সালে ‘বাংলাদেশ ইয়ুথ সার্ভে’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, সুইজারল্যান্ডের উন্নয়ন সংস্থা এসডিসি ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)। ওই গবেষণায়ও বাংলাদেশী তরুণীদের হিজাব ও বোরকায় ঝুঁকে পড়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৭ শতাংশ মুসলিম তরুণীই হিজাব পরিধান করে। এদের অধিকাংশই হিজাবকে গুরুত্বপূর্ণ পোশাক মনে করেন। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে সৌদি, দুবাই ও জর্ডান থেকে হিজাব ও বোরকা আমদানির পর স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে। পোশাকটি আমদানি করা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও চীন থেকেও। চাহিদা বাড়ায় এখন স্থানীয়ভাবেও অনেকেই বোরকা তৈরি করছেন। একেকটি বোরকা সর্বনিম্ন ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
পারিবারিক ঐতিহ্য, সামাজিক রীতিনীতি ও ধর্মীয় অনুশাসনই হিজাব-বোরকা পরিধানের কারণ বলে মনে করেন নারী উন্নয়ন কর্মী খুশি কবির। তিনি বলেন, ধর্মীয় পোশাক পরিধানে বাধ্য করা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ থাকলেও এটি বাড়ছে। কেননা হিজাব ও বোরকা না পরলে সামাজিকভাবে নারীকে বাঁকা চোখে দেখা হয়। বোরকা পরিধানের ক্ষেত্রে শারীরিকভাবে প্রভাব না খাটালেও মনস্তাত্ত্বিক একটি প্রভাব কাজ করে। উল্লেখ্য, ২০১০ সালের অক্টোবরে কোনো ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা যাবে না বলে রায় দেন হাইকোর্ট। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ দেশের কোনো দপ্তরে নারীদের বোরকা পরতে বাধ্য না করার নির্দেশ দেয়া হয় ওই রায়ে।