বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের জরিপবাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) নেতৃত্ব নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা আমেরিকা। সদ্য বিদায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বিনিয়োগের তথ্য পর্যালোচনা করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। এফডিআই-সংক্রান্ত বাংলাদেশের সর্বশেষ জরিপ থেকে এ তথ্য মিলেছে। গত অর্থবছরের বিনিয়োগের তথ্য থেকে বলা যায়, বাংলাদেশের বিদেশি বিনিয়োগে অন্যান্য দেশকে পেছনে ফেলে শীর্ষে উঠে এসেছে আমেরিকা। গ্যাস, পেট্রোলিয়াম ও বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে আমেরিকা এ নেতৃত্ব নিয়েছে। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শীর্ষে ছিল যুক্তরাজ্য। ওই বছর আমেরিকার বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় ২২ কোটি মার্কিন ডলার। সদ্য বিদায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এসে সেখানে আমেরিকা তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ দ্বিগুণ বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশে ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের প্রকৃত বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। যার মধ্যে আমেরিকার বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৫ কোটি মার্কিন ডলার। আমেরিকার এই ৪৫ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগের মধ্যে ৩৯ কোটি ডলারই এসেছে গ্যাস, পেট্রোলিয়াম ও বিদ্যুৎ খাতে। শুধু তা-ই নয়, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের যে প্রতিবেদন তাতে দেখা যাচ্ছে, ১৯৯৬-৯৭ থেকে ২০১৫-১৬ সাল—এই ২০ বছরের মধ্যে গত বছরই আমেরিকার সর্বোচ্চ বিনিয়োগ এসেছে বাংলাদেশে।
বিদ্যুৎ, পেট্রোলিয়াম ও গ্যাস খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর বাংলাদেশে আমেরিকার বিনিয়োগ বাড়াতে ‘শেভরন’ বড় ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) খাতেও আমেরিকার নতুন বিনিয়োগ এসেছে। যার ফলে গত বছর আমেরিকার বিনিয়োগ বেড়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, নতুন বিনিয়োগের পাশাপাশি কিছু পুনর্বিনিয়োগ মিলিয়ে আমেরিকা শীর্ষে উঠে এসেছে।
জানতে চাইলে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) সাবেক সভাপতি আফতাব-উল-ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল তৈরির যে কাজটি হাতে নেওয়া হয়েছে, তাতে আমেরিকার একটি বড় বিনিয়োগ এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে আমেরিকার পরের অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য। দেশটি থেকে গত অর্থবছরে বিনিয়োগ এসেছে ৩১ কোটি ডলার। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। গত অর্থবছরে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বিনিয়োগ এসেছে ১৪ কোটি ডলার। চতুর্থ অবস্থানে থাকা সিঙ্গাপুর থেকে এসেছে ১৩ কোটি ডলার। আর পঞ্চম অবস্থানে থাকা হংকং থেকে এসেছে ১২ কোটি ৬৯ লাখ মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ। অর্থাৎ গত অর্থবছরে বাংলাদেশে ২০০ কোটি ডলারের যে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, তার মধ্যে প্রায় ১১৬ কোটি ডলারই উল্লিখিত পাঁচ দেশ থেকে এসেছে। রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) ও ইপিজেডের বাইরে মিলিয়ে ২০০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। এর মধ্যে ইপিজেডের অভ্যন্তরে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৪৩ কোটি ডলার আর বাকি ১৫৭ কোটি ডলার ইপিজেডের বাইরে বিনিয়োগ হয়েছে।
বিদেশি বিনিয়োগে আমেরিকার শীর্ষে অবস্থান বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, জ্বালানি খাতে আমেরিকার নতুন কিছু বিনিয়োগ আসার কারণে দেশটি শীর্ষে উঠে গেছে। এতে সন্তুষ্ট হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশে আমেরিকার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে ‘শেভরন’। শোনা যাচ্ছে শেভরন বাংলাদেশ থেকে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়ার চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। সেটি যদি হয় তাহলে এ দেশে আমেরিকার বিনিয়োগ অনেক কমে যাবে।
যেসব খাতে বিনিয়োগ: গত অর্থবছরে দেশে যে পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, তার বড় অংশ এসেছে বস্ত্র খাতে। এ খাতটিই গত অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য শীর্ষে ছিল। ২০০ কোটি ডলারের মোট বিদেশি বিনিয়োগের মধ্যে প্রায় ৪০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ হয়েছে বস্ত্র খাতে। অর্থনীতিবিদদের মতে, অর্থনীতিকে গতিশীল করতে হলে কর্মসংস্থানমুখী বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। আর সেটি করতে হলে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কিন্তু উৎপাদনশীল খাতের চেয়ে সেবা খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে বাংলাদেশে।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেন, কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কিন্তু দেশি-বিদেশি মিলিয়ে এ খাতটিতে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ আসছে না। এ খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা জমির সমস্যা। এ ছাড়া বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও অবকাঠামোর মতো বাধাগুলো তো রয়েছেই।
বস্ত্র খাতের পর বিদেশি বিনিয়োগে গত অর্থবছরে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল টেলিকম খাত। এ খাতে বিনিয়োগ এসেছে প্রায় ২৭ কোটি ডলারের। তৃতীয় সর্বোচ্চ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ব্যাংকিং খাতে। এই খাতটিতে প্রায় সাড়ে ২৫ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। এরপর চতুর্থ অবস্থানে থাকা গ্যাস ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ এসেছে প্রায় ২২ কোটি ডলার, যার সিংহভাগই আমেরিকার। পঞ্চম অবস্থানে থাকা বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ এসেছে প্রায় ২১ কোটি ডলার। সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যুৎ খাতে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশে এ খাতে বিনিয়োগ বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে লাভজনক। এ জন্য বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগে দেশি-বিদেশিদের মধ্যে অতি উৎসাহ দেখা যাচ্ছে।