সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্বজুড়ে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই), আন্তর্জাতিক ঋণ ইস্যু ও বৈদেশিক বাণিজ্য কমেছে। উদারীকরণের প্রবক্তারা তাই মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়েই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) অর্ধবার্ষিক সভায় নীতিনির্ধারকদের বক্তব্যে এ উদ্বেগের প্রতিফলন দেখা গেছে। খবর এএফপি ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।
ধনী দেশগুলোয় গত বছর মোট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ৬৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকট-পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় তা ৪০ শতাংশ কম। এফডিআইয়ের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ঋণ ইস্যুর পরিমাণও কমেছে। আন্তঃসীমান্ত ব্যাংক-দাবির পরিমাণ থেকে ব্যাংক অব ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টস (বিআইএস) এ কথা জানিয়েছে। গত দুই বছরে এমন ব্যাংক দাবির পরিমাণ ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি ডলার বা ৯ শতাংশ কমেছে বলে বিআইএসের হিসাবে দেখা গেছে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) জানিয়েছে, ২০০৭ সালের পর এবারই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে মন্থর থাকবে। গত এপ্রিলে ডব্লিউটিও বৈশ্বিক বাণিজ্যে এ বছর ২ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল। সর্বশেষ নোটে সংস্থাটি এপ্রিলে দেয়া পূর্বাভাস কমিয়ে ১ দশমিক ৭ শতাংশে নামিয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ২০টি অর্থনীতির জিডিপিতে টানা চার বছর ধরে আমদানির অংশ কমছে। চার দশক ধরে পণ্যবাহী কনটেইনার চাহিদায় দুই অংকের প্রবৃদ্ধি ছিল। চলতি বছর কনটেইনার চাহিদার প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশে নেমেছে।
বিনিয়োগ ও বাণিজ্যপ্রবাহে ভাটা দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক অর্থনীতির নীতিনির্ধারকরা। তাদের আশঙ্কা, বিরাজমান মন্থরতার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ যদি অর্থনীতিকে অন্তর্মুখী করার উদ্যোগ নেয়, তাহলে মুক্ত বাণিজ্য পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে। মন্থরতা কাটিয়ে জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি জোরদার করতে অনেক দেশেই রাজনীতিকরা সংরক্ষণবাদের পক্ষে কথা বলছেন। ডব্লিউটিও মহাপরিচালক রবার্তো আজেভেদো বিষয়টিকে ‘ভুল প্রেসক্রিপশন’ বলে মন্তব্য করেছেন।
ডব্লিউটিও মহাপরিচালক রবার্তো আজেভেদো বলেন, প্রায়ই যে ওষুধটির কথা বলা হচ্ছে তা হলো সংরক্ষণবাদ। কিন্তু এটি হচ্ছে সে ওষুধ, যা রোগীর ভালো নয়, বরং ক্ষতি করবে। সংরক্ষণবাদী প্রবণতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আইএমএফ-প্রধান ক্রিস্টিন লাগার্দে বলেছেন, মুক্ত বাণিজ্য হ্রাস করলে বহু দশকজুড়ে নজিরবিহীন কল্যাণ আনয়নকারী ইঞ্জিনটি থেমে যাবে।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শ্লথ হয়ে পড়ায় ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ও ঝুঁকি থেকে পিছু হঠছে। কোম্পানিগুলো নতুন পণ্যে বিনিয়োগে দ্বিধান্বিত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন দেশের সরকারও প্রায়ই জাতীয় নিরাপত্তাসহ নানা বিবেচনা থেকে স্থানীয় কোম্পানিকে অগ্রাধিকার দিতে আইন পাস করছে।
উদীয়মান দেশগুলো নতুন ‘স্থানিকীকরণ’ আইন প্রণয়ন করছে, যাতে বড় কোম্পানিগুলো নির্দিষ্ট অঞ্চলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান করতে বাধ্য হয়। এ প্রক্রিয়ায় বড় কোম্পানিগুলো এক পর্যায়ে নিজ দেশে কার্যক্রম সংকোচনের পথে যাচ্ছে। অন্যদিকে ধনী দেশগুলো আন্তর্জাতিক কর ব্যবস্থা নিয়ে বিরোধে লিপ্ত হচ্ছে এবং কর হ্রাসে প্রণীত বিভিন্ন চুক্তি থেকে পিছু হঠছে। ধনী দেশগুলোর সাম্প্রতিক প্রবণতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময় থেকে প্রচলিত উদারীকরণের সম্পূর্ণ বিপরীত।
ভূরাজনৈতিক কারণে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা রাশিয়া ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করেছে। একইভাবে জাতীয় নিরাপত্তাজনিত কারণে আরোপিত বিধিনিষেধ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে মুক্ত বাণিজ্যে বিরাট বাধা সৃষ্টি করেছে। এ দেশগুলো টেলিকমের মতো বিভিন্ন স্পর্শকাতর শিল্পে করপোরেট প্রবেশাধিকার বন্ধ রেখেছে।
বাণিজ্য পর্যবেক্ষক সংস্থা গ্লোবাল ট্রেড অ্যালার্টের তথ্যমতে, শীর্ষস্থানীয় ২০টি অর্থনীতির পক্ষ থেকে ২০১৫ সালে অন্যান্য দেশের বিরুদ্ধে ৬৪৪টি বৈষম্যমূলক বাণিজ্য-বিধি আরোপ করা হয়েছে। বৈষম্যমূলক বিধি প্রণয়নে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে বলে গ্লোবাল ট্রেড অ্যালার্ট উল্লেখ করেছে। ডাম্পিংয়ের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের পণ্যে শাস্তিমূলক শুল্কারোপ করেছে।
চীনের অর্থনীতির সংস্কার বিলম্বিত হওয়াও বাণিজ্য মন্থরতার জন্য দায়ী। প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় চীন সরকার বাজার উদারীকরণের পরিবর্তে স্থানীয় শিল্পের জন্য প্রাধিকারমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের এক জরিপে তিন-চতুর্থাংশের বেশি কোম্পানি জানিয়েছে, এক বছর আগের চেয়ে তারা চীনে কম সমাদর বোধ করছে।
বাণিজ্যের পরিমাণ ও পরিধি হ্রাস পাওয়ায় এইচএসবিসির ব্যাংকগুলোর চলার পথও পাল্টে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এইচএসবিসি তুলনামূলক ছোট ১৬টি দেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। এইচএসবিসির সম্পদ মূলত চীন ও যুক্তরাজ্যে কেন্দ্রীভূত। একদিকে চীনা অর্থনীতির রূপান্তর, অন্যদিকে ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ত্যাগ— দুদিকেই ঝুঁকিতে রয়েছে ব্যাংকটি।
ইইউর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত ট্রান্স-আটলান্টিক ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পার্টনারশিপ (টিটিআইপি) চুক্তি বিরুদ্ধ জনমতের চাপে আটকা পড়েছে। ইইউ কর্মকর্তারা গত মাসে বলেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় এ চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা নেই। ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস ও জার্মানিতে নির্বাচনের কথা থাকায় আগামী বছরও টিটিআইপি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা ক্ষীণ। টিটিআইপির মতো আটকা পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি।
বিশ্বজুড়ে মুক্ত বাণিজ্যকে বাঁচাতে অর্থনৈতিক অসাম্য নিরসনের পরামর্শ দিয়েছেন জার্মান অর্থমন্ত্রী ভুলফগ্যাং শোয়েবল। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের সভায় তিনি বলেছেন, আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে রাজনীতি, অর্থনীতি ও গণমাধ্যমে নেতৃত্বদানকারী ক্ষমতাবানদের সঙ্গে সাধারণ জনগণের ব্যবধান বাড়তে দেয়া যাবে না।