দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। কারখানার ত্রুটি সংস্কারে নানা উদ্যোগও চলছে। তার পরও সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, এ খাতের ৩৯ শতাংশ কারখানা অগ্নিনিরাপত্তা ত্রুটি নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে। শ্রম আইন অনুযায়ী দেশের শিল্প-কারখানার কর্ম ও শ্রম পরিবেশ নজরদারির দায়িত্ব শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের। সব খাতের কারখানাই নিয়মিত পরিদর্শন করেন অধিদপ্তরের পরিদর্শকরা। আর কমপ্লায়েন্স ইস্যু বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরি হয় পোশাক খাতের। অধিদপ্তরের তৈরি পরিদর্শন প্রতিবেদনেই ৩৯ শতাংশ কারখানায় অগ্নিনিরাপত্তা ত্রুটির বিষয়টি উঠে এসেছে।
জানা গেছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুন পরিদর্শন করা হয়েছে মোট ১ হাজার ২৩৬টি কারখানা। এর মধ্যে ৮১৬টি কারখানা পোশাক শিল্প মালিক সংগঠন বিজিএমইএর সদস্য। আরেক সংগঠন বিকেএমইএর সদস্য কারখানা ২৩৬টি। কোনো সংগঠনের সদস্য নয়, এমন কারখানার সংখ্যা ১৮৪। এর মধ্যে ৭৫৩টি বা ৬১ শতাংশ কারখানায় অগ্নি প্রতিরোধ ও নিরাপত্তা-সংক্রান্ত ব্যবস্থা আছে।
তথ্যমতে, বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত ৮১৬টি কারখানার মধ্যে ৫০৩টি বা ৬২ শতাংশে অগ্নি প্রতিরোধ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে। এ হিসাবে বাকি ৩৮ শতাংশ কারখানায় অগ্নিনিরাপত্তা ত্রুটি রয়েছে। বিকেএমইএর সদস্য ২৩৬টি কারখানার ৮৩ শতাংশ বা ১৯৫টিতে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলেও অনুপস্থিত বাকি ১৭ শতাংশ কারখানায়। সংগঠনের সদস্য নয়, এমন ১৮৪টি কারখানার ৫৫টি বা ৩০ শতাংশে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকলেও বাকি ৭০ শতাংশ অগ্নিনিরাপত্তায় ত্রুটি রয়েছে। জানতে চাইলে কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) মহাপরিদর্শক সৈয়দ আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, এত দুর্ঘটনার পরও কেন অগ্নি প্রতিরোধ ও নিরাপত্তা-সংক্রান্ত ব্যবস্থার ঘাটতি আছে, কেন তারা এখনো ঘুমিয়ে আছেন— এর উত্তর সংশ্লিষ্ট মালিকরাই ভালো বলতে পারবেন। প্রতিবেদনে পরিদর্শনের ফলাফলটাই উঠে এসেছে। অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এসব অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাও নিয়মিতভাবে নেয়া হয়।
২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনন্সে অগ্নিকাণ্ডের পর ২০১৩তে ঘটে রানা প্লাজা ধস। এ দুই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগে প্রায় আড়াই বছর ধরে চলছে পোশাক খাত মূল্যায়ন কার্যক্রম। এ কার্যক্রমের আওতায় থাকা সাড়ে তিন হাজার কারখানার অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও স্থাপত্য ব্যবস্থার পরিদর্শন চলছে। ইউরোপভিত্তিক অ্যাকর্ড, উত্তর আমেরিকার অ্যালায়েন্সসহ জাতীয় উদ্যোগের পরিদর্শনে কারখানায় অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও স্থাপত্য ব্যবস্থার ত্রুটি শনাক্ত হয়েছে। শুধু অ্যাকর্ডের প্রায় ১ হাজার ৫০০ কারখানায় শনাক্ত হওয়া অগ্নি-সংক্রান্ত ত্রুটি আছে ৩২ হাজার ৮৯৪টি। শনাক্ত হওয়া ত্রুটির সংশোধন কার্যক্রমও চলমান।
তবে এতসব কর্মযজ্ঞের পরও ত্রুটিপূর্ণ অগ্নি প্রতিরোধ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার সরকারি অনুসন্ধানের সঙ্গে একমত নয় পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। সংগঠনটির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, সরকারি সংস্থার হিসাবের সঙ্গে আমি একমত নই। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের আওতায় থাকা কারখানাগুলোর অগ্নি প্রতিরোধ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় শনাক্ত হওয়া ত্রুটির অধিকাংশই সংশোধন হয়েছে। জাতীয় উদ্যোগের আওতায় থাকা কারখানায় কিছু ত্রুটি থাকতে পারে। এদিকে পোশাক শিল্পের নিট খাতের সংগঠন বিকেএমইএ সূত্র বলছে, অধিদপ্তরের পরিদর্শনে বিকেএমইএর যেসব কারখানায় ত্রুটি দেখা গেছে তাদের মধ্যে অনেকে সংগঠনের সদস্য হলেও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি রফতানির সঙ্গে সম্পৃক্ত নেই। তবে রফতানির সঙ্গে সম্পৃক্ত না হলেও কারখানায় অগ্নি-সংক্রান্ত কোনো ত্রুটি থাকা যাবে না, সংগঠনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।
বিকেএমইএর সহসভাপতি মনসুর আহমেদ বলেন, অধিদপ্তরের পরিদর্শনে যে কারখানাগুলোয় ত্রুটি শনাক্ত হয়েছে, তারা সংগঠনের সদস্য হলেও বেশির ভাগই একসময় রফতানির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। এখন তারা পরোক্ষ বা প্রচ্ছন্ন রফতানিকারক। সরাসরি রফতানির সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন কোনো কারখানায় ত্রুটি থাকলে তারা বিকেএমইএ থেকে কোনো সেবা পায় না। তবে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে পরোক্ষ রফতানিকারকদেরও সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়নের বাধ্যবাধকতা আরোপের। অধিদপ্তরের মাসভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুলাইয়ে তারা ১৪৮টি কারখানা পরিদর্শন করেছে। এর মধ্যে ১১২টি বিজিএমইএর সদস্য। বিকেএমইএর সদস্য ২৩টি ও সংগঠনের সদস্য নয়, এমন কারখানা ১৩টি। এর মধ্যে ২৯ শতাংশ কারখানায় অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি পাওয়া গেছে। বিজিএমইএর ২৫ ও বিকেএমইএর ২৬ শতাংশ কারখানায় এ ত্রুটি পাওয়া গেছে।