দেশের আমদানি-রফতানিতে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ৯০ শতাংশের বেশি হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। বর্তমানে আমদানি-রফতানি যে হারে বাড়ছে, তাতে ২০১৯ সাল নাগাদ দেশের প্রধান এ সমুদ্রবন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের চাহিদা থাকবে ২৬ লাখ টিইইউএস। এর বিপরীতে সক্ষমতা থাকবে ২৩ লাখ ৮০ হাজার টিইইউএস। এ সময়ের মধ্যে নতুন টার্মিনাল নির্মাণ করা না গেলে সক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যাবে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের চাহিদা। তবে বন্দরের যে প্রস্তুতি, তাতে আগামী তিন বছরের মধ্যে নতুন টার্মিনাল নির্মাণ সম্ভব হবে না বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য কৌশলগত মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে জার্মানির হামবুর্গ পোর্ট কনসালটিং (এইচপিসি)। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে তৈরি কৌশলগত মহাপরিকল্পনার খসড়ায় আগামীতে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের চাহিদা ও সক্ষমতার তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেছে এইচপিসি।
খসড়ায় বলা হয়েছে, নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পুরোদমে কার্যক্রম পরিচালনা করলে ২০১৭ সালে বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা দাঁড়াবে ২৩ লাখ ৬০ হাজার টিইইউএস। এর বিপরীতে পণ্য ওঠানামা হবে ২১ লাখ ৬৮ হাজার টিইইউএস। ২০১৮ সালে গিয়ে ২৩ লাখ ৭০ হাজার টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা তৈরি হবে বন্দরের। সে নাগাদ কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের চাহিদা দাঁড়াবে ২৩ লাখ ৯৮ হাজার টিইইউএস। তবে এর পরের বছর ২০১৯ সালে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের চাহিদা হবে ২৬ লাখ ৪৬ হাজার টিইইউএস। এর বিপরীতে সক্ষমতা থাকবে ২৩ লাখ ৮০ হাজার টিইইউএস।
তবে ২০১৮ সালের মধ্যে কর্ণফুলী কনটেইনার টার্মিনাল (কেসিটি) নির্মাণ সম্পন্ন করা গেলে চট্টগ্রাম বন্দরকে এ সমস্যায় পড়তে হবে না বলে খসড়ায় উল্লেখ করেছে এইচপিসি। আর ২০২৩ সালের মধ্যে প্রস্তাবিত বে-টার্মিনালের নির্মাণ শেষ হলে আগামী ৩০ বছর চাহিদা অনুযায়ী কনটেইনার হ্যান্ডলিং সম্ভব হবে বলে মনে করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি। যদিও এসব টার্মিনাল নির্মাণের কাজ এখনো প্রাথমিক পর্যায়েই রয়ে গেছে। বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় আট বছর আগে চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান ১১, ১২ ও ১৩ নম্বর জেটি ভেঙে কেসিটি নির্মাণের পদক্ষেপ নেয়া হয়। ৬০০ মিটার দীর্ঘ জেটিতে একই সঙ্গে তিনটি ভেসেলের বার্থিং সুবিধা রেখে প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়। পরামর্শক নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রকল্পের সব কাজ তিন বছরের মধ্যে শেষ করার কথা। কিন্তু আট বছরেও প্রকল্পের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
২০১৮ সালের মধ্যে তাই কেসিটি নির্মাণ শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না চট্টগ্রাম চেম্বারের বন্দর ও জাহাজীকরণ-বিষয়ক উপকমিটির আহ্বায়ক মাহফুজুল হক শাহ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, নতুন টার্মিনাল নির্মাণের কথা বলা হলেও সেগুলোর কার্যক্রম চলছে ধীরগতিতে। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের বর্ধিত চাপ সামাল দিতে ২০১৮ সালের মধ্যে কেসিটি নির্মাণের কথা বলা হলেও ওই সময়ের মধ্যে তা সম্ভব হবে না। কারণ এখনো যদি পুরোদমে কাজ শুরু হয়, তা হলেও নির্মাণ শেষ করতে সময় লেগে যাবে অন্তত পাঁচ বছর। অবস্থাদৃষ্টে স্পষ্টভাবেই বলা যায়, ২০১৯ সালে কনটেইনার পরিবহনের যে চাপ তৈরি হবে, তা কোনোভাবেই সামাল দিতে পারবে না চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বে-টার্মিনালের সমীক্ষাও এখনো শুরুর পর্যায়ে রয়েছে। জার্মান প্রতিষ্ঠান শেল হর্নের নেতৃত্বে দেশটির এইচপিসি ও বাংলাদেশের কেএস কনসালট্যান্টস লিমিটেড যৌথভাবে সমীক্ষাটি করবে। এছাড়া পতেঙ্গার লালদিয়া বাল্ক টার্মিনালের প্রস্তাবিত জায়গার বসতি স্থানান্তরেরও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য (পরিকল্পনা ও প্রশাসন) জাফর আলম বলেন, প্রতি বছরই কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের চাপ বাড়ছে। দ্রুততম সময়ে টার্মিনাল নির্মাণের বিকল্প নেই। মহাপরিকল্পনার পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০১৯ সাল থেকে সক্ষমতার অতিরিক্ত কনটেইনার আসবে বন্দরে। এ চাপ সামাল দিতে বে-টার্মিনাল ছাড়াও বন্দর এলাকায় কর্ণফুলী কনটেইনার টার্মিনাল, পতেঙ্গা এলাকায় পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল ও লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণের কার্যক্রম হাতে নেয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত সাত বছরে বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা দ্বিগুণ হয়েছে। বছরভিত্তিক হিসাবে ২০০৮ সালে বন্দর দিয়ে কনটেইনার পরিবহন হয়েছে ১০ লাখ ৬৯ হাজার টিইইউএস। পরের তিন বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ লাখ ৪১ হাজার, ১৭ লাখ ৩১২ হাজার ও ২০ লাখ ২৪ হাজার টিইইউএসে। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের এ চাহিদা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে।
বর্ধিত এ চাহিদা মেটাতে বে-টার্মিনাল নির্মাণের বিকল্প নেই বলে মনে করেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য কয়লা আমদানি ও একই সঙ্গে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস নিয়ে প্রচুর জাহাজ আসা-যাওয়া করবে। জাহাজের তুলনায় জেটির সংখ্যা কম থাকায় অপেক্ষাকৃত বড় কনটেইনারবাহী জাহাজগুলোকে কয়েক দিন পর্যন্ত সাগরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। মহাপরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ না হলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, বন্দরে প্রথম টার্মিনাল নির্মাণ হয় ১৯৯২ সালে। এর সাত বছর পর এনসিটি নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। আট বছর পর এক কিলোমিটার দীর্ঘ পাঁচ জেটির টার্মিনালটি নির্মাণ হয় ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে। এরপর আর কোনো নতুন টার্মিনাল নির্মাণ হয়নি বন্দরে।