অবৈধ পন্থায় হস্তান্তর হয়েছে জমি। সেই জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে দ্বিতল বেজমেন্টের ওপর গ্রাউন্ড ফ্লোরসহ ১৫ তলা বিজিএমইএ কমপ্লেক্স। ক্রয়-নিবন্ধন ছাড়াই ভবনটির স্পেস কিনেছেন বিজিএমইএর সদস্য পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। ভবনটি ভেঙে ফেলতে উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর এখন লগ্নি করা অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন তারা।
বিজিএমইএ ভবন ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়ে গত জুনে দেয়া আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে চলতি মাসে। রায়ের এ কপি হাতে পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে ভেঙে ফেলতে হবে ভবনটি। সে হিসাবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রায় কার্যকর হলে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি নাগাদ হাতিরঝিলের ভবনটি দৃশ্যমান থাকবে না। এদিকে অবৈধ ভবনের বিভিন্ন তলায় স্পেস ক্রেতাদের পক্ষ থেকে দাবি হাতে পাওয়ার ১২ মাসের মধ্যে অর্থ ফেরতেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে রায়ে। তবে এ রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করা হবে বলে বিজিএমইএ সূত্র জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সূত্রগুলো বলছে, রায়ের পর এ নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। এ অবস্থায় ক্ষতি মেনে নিলেও ভবনে করা লগ্নির ভবিষ্যত্ সম্পর্কে কিছু বলতে পারছেন না তারা। রিভিউ আবেদন-পরবর্তী সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বিজিএমইএর পদক্ষেপের অপেক্ষা করছেন তারা।
জানা গেছে, রাজধানীর হাতিরঝিলে স্থাপিত বিজিএমইএ ভবনে ২ লাখ ৬৫ হাজার বর্গফুট স্পেস আছে। প্রতিটি স্পেসের মালিকানায় আছেন বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও পোশাক শিল্প কারখানা-সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে শিল্পকারখানা মালিকদের আধিক্যই বেশি, যার মধ্যে আছেন বিজিএমইএর পরিচালনা পর্ষদের বর্তমান ও সাবেক নেতারা।
বিজিএমএই ভবনে আছে মোট ১৫টি তলা। এর নিচে আছে গ্রাউন্ড ফ্লোর, বেজমেন্ট ১ ও ২। প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় আংশিক জায়গাজুড়ে রয়েছে বিজিএমইএ অডিটোরিয়াম, বাকি স্পেসগুলোয় আছে ঢাকা ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকের কার্যালয়। তৃতীয় ও চতুর্থ ফ্লোর পুরোটা এবং পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার কিছু অংশের স্পেস বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান (অ্যালোটি) বিজিএমইএ। ১৪ ও ১৫তম তলাও পুরোটা ব্যবহার হয় বিজিএমইএর দাপ্তরিক, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন কার্যক্রমে। বাকি সব ফ্লোরের স্পেস কিনেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
ভবনের ১২ ও ১৩তম তলার ১৪ হাজার বর্গফুটের পুরোটাই অ্যালোটি বা বরাদ্দপ্রাপ্ত হলো ডিবিএল গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠান। এ গ্রুপের ফ্লেমিঙ্গো ফ্যাশন ও জিন্নাত অ্যাপারেলসের অফিস চালু রয়েছে ফ্লোর দুটিতে। এছাড়া ১০ ও ১১তম তলায় আংশিক স্পেস ভাড়া নিয়ে অফিস চালু আছে ডিবিএল গ্রুপের। ১১তম তলায় স্পেস বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে তিনটি। এগুলো হলো— এশিয়ান অ্যাপারেলস লিমিটেড, ডায়নামিক ফ্যাশনস লিমিটেড ও এভিন্স ড্রেস শার্ট।
এ বিষয়ে ডিবিএল গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোহাম্মদ আবদুল কাদের বণিক বার্তাকে বলেন, আমরাসহ ভবনে লগ্নিকারী যারা আছেন, আইন অনুযায়ী তাদের জন্য সিদ্ধান্ত আছে। কীভাবে তা বাস্তবায়ন হবে, এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না। অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হলেও আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়ে সংশয় ও অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
দশম তলায় স্পেস বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে রাসেল গ্রুপ, আজমত অ্যাপারেলস, জেড-থ্রি ড্রেস লিমিটেড, মিলেনিয়াম (ডাইন্যাস্টি) সোয়েটার্স লিমিটেড, সিনহা উলওয়্যার্স লিমিটেড, হাসেন সোয়েটার্স লিমিটেড ও বনানী হোসিয়ারি লিমিটেড। নবম তলায় স্পেস বরাদ্দ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছয়। এগুলো হলো— রূপা ফ্যাশন, এসকোয়্যার নিট লিমিটেড, সোলার গার্মেন্টস লিমিটেড, শার্ট মেকার্স লিমিটেড, ইন্টারন্যাশনাল শার্ট লিমিটেড ও গোমতি টেক্সটাইল্স।
শার্ট মেকার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহাদাত মুশার্রফ খান বলেন, বরাদ্দ পাওয়া স্পেস-সংক্রান্ত বিষয় সুরাহা নিয়ে কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। কোনো না কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা অবশ্যই নেয়া হবে। তা যদি সাংগঠনিকভাবে না হয়, ব্যক্তি উদ্যোগেও নিতে হতে পারে। অনানুষ্ঠানিকভাবে যতটুকু জানি, বিজিএমইএ ভবন যেখানে নতুন করে নির্মাণ হবে, সেখানে আমাদের স্পেস দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
ভবনের অষ্টম তলায় স্পেস কিনেছে আটটি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো— সুরমা গার্মেন্টস লিমিটেড, সাভার টেক্সটাইলস লিমিটেড, নাসরিন গার্মেন্টস লিমিটেড, রিদম গার্মেন্ট লিমিটেড, উইন ওয়্যার লিমিটেড, চয়েজ গার্মেন্ট, এস সুহি ইন্ডাস্ট্রিজ ও বিজনেস রিসোর্সেস। সপ্তম তলায় একটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য থাকলেও এ ফ্লোরটি অব্যবহৃত রয়েছে।
ষষ্ঠ তলায় আছে বিজিএমইএসহ সাতটি প্রতিষ্ঠানের স্পেস। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো— অরুণিমা অ্যাপারেল্স লিমিটেড, ওলিও অ্যাপারেলস লিমিটেড, বান্দো ডিজাইন লিমিটেড, সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্স, ফ্যাশনস লিমিটেড ও ক্লিফটন অ্যাপারেলস লিমিটেড। পঞ্চম তলায় বিজিএমইএসহ চার প্রতিষ্ঠানের স্পেস রয়েছে। এর মধ্যে আছে ইন্টারস্টফ অ্যাপারেলস, কাত্তালি অ্যাপারেলস লিমিটেড, স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপ ও ব্লেজার অ্যাপারেলস। প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় আছে যথাক্রমে ঢাকা ব্যাংক লিমিটেড ও এক্সিম ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের অফিস। সব মিলিয়ে বিজিএমইএ ভবনের স্পেস রয়েছে ৩৮ প্রতিষ্ঠানের। বিজিএমইএর সূত্র জানিয়েছে, আদালতের আদেশ থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সংগঠনের তরফ থেকে কোনো অর্থ ফেরত দেয়া সম্ভব হবে না।
এ বিষয়ে ইন্টারস্টফ অ্যাপারেলস লিমিটেডের পরিচালক শেখ মো. ইলিয়াস বলেন, রায় যথাযথ ও সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন হবে, এটা সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা। সম্পদ নষ্ট হলেও এখন তা বাস্তবতা। স্পেস বরাদ্দপ্রাপ্তদের সঙ্গে এ বিষয়ে সুরাহার পুরো প্রক্রিয়াটি কী ও কেমন হবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আদালত ভবন প্রসঙ্গে রায় দিয়েছেন। এখন যা হবে, তা রায়ে দেয়া দিকনির্দেশনা অনুযায়ী হবে। ভবনটিতে আমাদের ব্যাংকের কার্যক্রম অন্যত্র পরিচালনার জন্য আমরা এরই মধ্যে বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছি। বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ রিভিউ করবে বলে জানতে পেরেছি। তাদের এ পদক্ষেপের পরই স্পেসের ভবিষ্যত্ নিয়ে স্পষ্ট করে বলা সম্ভব হবে।
ব্লেজার অ্যাপারেলসের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার জাকির হোসেন বলেন, স্পেস নিয়ে এখন কিছু বলা যাচ্ছে না। কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বুঝে পেলেও কোনো রেজিস্ট্রেশন হয়নি। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে থাকলে চিন্তা কিছুটা কম হতো। এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনাও এখনো হয়নি।
বিজিএমইএ ভবনে রয়েছে সংগঠনটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট সিদ্দিকুর রহমানের মালিকানাধীন বান্দো ডিজাইন লিমিটেডের কার্যালয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আদালতের রায়ের পর এখনো রিভিউ করার সুযোগ আমাদের রয়েছে। তা করা হবে। রিভিউ-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে ভবনের স্পেস বরাদ্দপ্রাপ্তদের বিষয়ে পরিকল্পনা নেয়া হবে।