চীনে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। জাপান, কোরিয়ার মতো পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে বাড়ছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা। তাহলে ভবিষ্যতে কোন অঞ্চল হবে বিশ্বের কারখানা বা শিল্পের ঠিকানা? কোন অঞ্চলে গড়ে উঠবে শ্রমঘন শিল্প?
বিশ্বব্যাংকের নতুন এক প্রতিবেদন বলছে, এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার সম্ভাবনা প্রশ্নাতীত। ২০৩০ সালে বিশ্বের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ৪ ভাগের ১ ভাগ বাস করবে দক্ষিণ এশিয়ায়। এই অঞ্চলে মানুষের শিক্ষার হার বাড়ছে। প্রতি মাসে ১০ লাখ নতুন মুখ চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে। নগরায়ণও হচ্ছে দ্রুতগতিতে। এত সব উপযোগী উপাদান থাকার পরও দক্ষিণ এশিয়াকে ঠেকানোর কে আছে? বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই অঞ্চলের সম্ভাবনার পথে কাঁটা পুঁতে রেখেছে দেশগুলো নিজেরাই। বিনিয়োগ আকর্ষণে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অন্যান্য অঞ্চলের প্রতিযোগীর চেয়ে কম। বৈশ্বিক বিভিন্ন সূচকে এই অঞ্চলের দেশগুলোর অবস্থান তলানিতে। এই অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্যের মান ততটা ভালো নয়, পণ্যের সংখ্যা এবং বাজারও গুটিকয়েক। দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য যোগাযোগও সীমিত।
সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এই অঞ্চলের দেশগুলোকে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে বলা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে। এ জন্য ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করা, বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, ব্যবস্থাপনা ও শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং পাশাপাশি অবস্থানের সুযোগ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির নতুন এ প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘সাউথ এশিয়াজ টার্ন: পলিসিজ টু বুস্ট কম্পিটিটিভনেস অ্যান্ড ক্রিয়েট দ্য নেক্সট এক্সপোর্ট পাওয়ারহাউস’। প্রায় ২০০ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদনে বিভিন্ন গবেষণা, বৈশ্বিক সূচক, নিজস্ব বিশ্লেষণের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিযোগিতা সক্ষমতা, উৎপাদনশীলতা পরিস্থিতি ও করণীয় তুলে ধরা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে এ প্রতিবেদন প্রসঙ্গে দেওয়া এক বক্তব্যে সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যানেট ডিক্সন বলেন, আয় বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক বাজারে নিজেদের অংশীদারত্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এমন নীতি নিতে হবে, যা উৎপাদশীলতা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করবে।
চীনে খরচ বাড়লে রপ্তানি আয় বেশি বাড়বে বাংলাদেশের: চীনে উৎপাদন খরচ বাড়লে তার প্রভাব কী হবে, তা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, চীনে পণ্য উৎপাদন খরচ ১০ শতাংশ বাড়লে দেশটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানি প্রায় ৮ শতাংশ কমবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ বাড়বে, অর্থ মূল্যের দিক থেকে যার পরিমাণ প্রায় ৫২ কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি বাড়বে ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ বা প্রায় ৪২ কোটি ডলার। পাকিস্তানের বাড়বে ২৫ শতাংশ, যা প্রায় ৩৪ কোটি ডলারের সমান। তবে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার রপ্তানি আয় আরও বেশি হারে বাড়তে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে। ইউরোপে উৎপাদন খরচ বাড়লে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান বিশেষ কোনো সুবিধা পাবে না বলে উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনে। বলা হয়, এতে সুবিধা পাবে ভারত ও শ্রীলঙ্কা।
বৈশ্বিক বাজারে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বাংলাদেশ: প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়া পণ্য রপ্তানি আয়ে বেশ ভালো হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও বৈশ্বিক বাজারের মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ দখলে আনতে পেরেছে। এর মধ্যে বেশি অংশীদারত্ব ভারতের, ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। অন্যদিকে শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ নিয়ে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানসহ শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপের অংশ আরও কমেছে। কিছুটা বেড়েছে আফগানিস্তানের। এ রপ্তানি আয় আবার নির্দিষ্ট কিছু পণ্য ও বাজার থেকে এসেছে। বাংলাদেশ, নেপাল, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা উচ্চমাত্রায় পোশাকের ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া ভুটান খনিজের ওপর এবং আফগানিস্তান ও মালদ্বীপ কৃষিপণ্যের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০০১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত এই অঞ্চলের রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ৮০ শতাংশ এসেছে একই পণ্য ও একই বাজারে রপ্তানি করে। বাকি ২০ শতাংশ এসেছে একই পণ্য নতুন বাজারে বিক্রি করে।
বড় ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের হার বাংলাদেশে বেশি: বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠান বড় হলে তার উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। এই অঞ্চলের দেশগুলোতে ছোট ও মাঝারি কোম্পানির সংখ্যাই বেশি, এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ২৭ শতাংশের আকার বড়। অন্যদিকে ভারতের প্রায় ১৩ শতাংশ, পাকিস্তানের ১৬, ফিলিপাইনের ১৩, ইন্দোনেশিয়ার ২, চীনের ১৩, ভিয়েতনামের ১৮ ও শ্রীলঙ্কার ৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের আকার বড়। বড় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অর্থ সংগ্রহ, ভালো কর্মী নিয়োগ, ঝুঁকি নেওয়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সক্ষমতা বেশি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
গবেষণা ও উন্নয়নে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে: বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গবেষণা ও উন্নয়নে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের হার ভারত ও বাংলাদেশে বেশি। এমনকি এ হার পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর চেয়েও বেশি। তবে পাকিস্তান ও নেপালে এ হার অত্যন্ত কম। বাংলাদেশে বড়, রপ্তানিমুখী, বিদেশি ও পুরোনো কোম্পানিগুলোর মধ্যে গবেষণা ও উন্নয়নের প্রবণতা বেশি। ভারতের ৫৬ শতাংশ, বাংলাদেশের ১৯ শতাংশ, পাকিস্তানের ৬ শতাংশ, নেপালের ৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠান গবেষণা উন্নয়নের চেষ্টা চালায় বলে ওই প্রতিবেদনের তথ্য। এখানে গবেষণা ও উন্নয়ন বলতে মূলত নতুন পণ্য বাজারে ছাড়া, মান বৃদ্ধি, উৎপাদনে নতুন প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার ইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষেত্রে এ উন্নয়ন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনুকরণ করা। এ দুই দেশের কোম্পানিগুলো বিভিন্ন পণ্য ও প্রক্রিয়া দেখে সেটি নিজেরা উৎপাদন অথবা ব্যবহার করে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
পোশাকে বাংলাদেশের ভরসা কেবল কম উৎপাদন খরচ: বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও উৎপাদন খরচের বাইরে অন্যদিকগুলোতে এ দেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা নেই। পণ্যের মান, লিড টাইম (ক্রয়াদেশ পাওয়ার পরে ক্রেতাকে বুঝিয়ে দেওয়ার সময়), সামাজিক কমপ্লায়েন্স ও টেকসই—এসব ক্ষেত্রে চীন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও কম্বোডিয়া বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে ভারত অবশ্য বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে। প্রতিবেদনে মান, লিড টাইম ও কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতকে লাল রং দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মানে হলো, এগুলো গুরুত্বপূর্ণ বাধা।
তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত: প্রতিষ্ঠানে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ও নেপালের অর্ধেকের প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার ব্যবহার করে। আফ্রিকার গড় হারের চেয়েও তা কম। এ ক্ষেত্রে ভারতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার প্রায় শতভাগ। পাকিস্তানের ৭১ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে অন্তত একজন ব্যক্তি কম্পিউটার ব্যবহার করে। অবশ্য তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের এ পরিসংখ্যান নেওয়া হয়েছে ২০১৩ ও ২০১৪ সালের ওপর ভিত্তি করে।