অফিস কমপ্লেক্স গড়ে তোলার নামে ভূমিদস্যুদের দলে যোগ দিয়েছে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। বেগুনবাড়ি খাল ও হাতিরঝিল লেকের ওপর ভবনটি নির্মাণে সরকার ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছ থেকে অনুমোদনও আদায় করেছে সংগঠনটি। এর পর সংশ্লিষ্ট সব আইন লঙ্ঘন করে ১৫ তলাবিশিষ্ট বিজিএমইএ কমপ্লেক্স গড়ে তুলেছে তারা। বিজিএমইএ ভবন ভেঙে ফেলতে গত ২ জুন দেয়া আদেশের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ কথা বলেছেন আপিল বিভাগ। পাশাপাশি অনতিবিলম্বে নিজ খরচে ভবনটি ভেঙে ফেলতে বিজিএমইএর প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত। এতে ব্যর্থ হলে রায়ের কপি পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজউক) ভবনটি ভেঙে ফেলতে বলা হয়েছে। ভবন ভাঙার খরচও বিজিএমইএর কাছ থেকে আদায় করতে বলেছেন আপিল বিভাগ।
রাজধানীর বেগুনবাড়ি খালের ওপর গড়ে তোলা বিজিএমইএ ভবন ভেঙে ফেলতে হাইকোর্টের দেয়া আদেশ বহাল রেখে গত ২ জুন রায় দেন আপিল বিভাগ। ৩৫ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় গতকাল সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকেও রায়ের কপি পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান গতকাল বণিক বার্তাকে বলেন, আদালতের রায়ের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। রিভিউ আবেদনের সুযোগ আছে ও তা করা হবে। আমি দেশের বাইরে আছি। দেশে ফিরে সবার সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব। সে অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে, জলাশয় ভরাট করে ভবন নির্মাণ করায় তা বেআইনি হয়েছে। এছাড়া ওই জমি ছিল বাংলাদেশ রেলওয়ের। এ জমি রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) নামে হস্তান্তরের আগে বিজিএমইএর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। ফলে আইনের চোখে সেটিও বৈধ নয়।
জলাশয় ভরাট করে বিজিএমইএ ভবন গড়ে তোলার বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, হাতিরঝিল লেক ও বেগুনবাড়ি খাল দখলকারীদের হাত থেকে রক্ষা করতে রাজউকের মাধ্যমে সরকার ১ হাজার ৪৮০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়সংবলিত হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রকল্প নেয়। কিন্তু বিজিএমইএ ভবন নির্মাণের নামে দুটি জলাশয়কে গ্রাস করে। এতে সাধারণ মানুষ হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। হাতিরঝিল ও বেগুনবাড়ি জলাশয় রক্ষায় শুরু থেকেই অবৈধ এ ভবন নির্মাণের বিরোধিতা করে আসছিলেন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ।
২০০৩ সালের জুলাইয়ে শর্তসাপেক্ষে বিজিএমইএ ভবনের নকশা অনুমোদন করে রাজউক। এর পর ২০০৬ সালের আগস্টে রাজউক এক চিঠিতে বিজিএমইএকে অননুমোদিত অবকাঠামো সরিয়ে ফেলতে বলে। সেই সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ অনুমোদনের আগে নির্মাণকাজ শুরু করায় বিজিএমইএকে সাড়ে ১২ লাখ টাকা জরিমানা করে। এর মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান হয় যে, চূড়ান্ত অনুমোদনের আগেই ভবনটি নির্মাণ করা হয়। রাজউকের অনুমোদন ছাড়া বিজিএমইএ ভবন নির্মাণ করছে উল্লেখ করে ২০১০ সালের ২ অক্টোবর একটি ইংরেজি দৈনিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি আদালতের দৃষ্টিতে আনা হলে বিজিএমইএ ভবন ভাঙা হবে কিনা, তা জানতে চেয়ে ওই বছরের ৩ অক্টোবর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন আদালত। রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল বিজিএমইএ ভবন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট।
রায়ে ৯০ দিনের মধ্যে ভবনটি ভাঙার নির্দেশ দেয়া হয়। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই বিজিএমইএ ভবন অপসারণের আদেশ স্থগিত চেয়ে আবেদন করলে ওই বছর ৫ এপ্রিল হাইকোর্টের রায়ের ওপর ছয় সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দেন সে সময়ের চেম্বার বিচারপতি। পরবর্তীতে আপিল বিভাগ স্থগিতাদেশের মেয়াদ আরো বাড়ান। পরে ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাইকোর্ট বলেন, জমিটির ওপর বিজিএমইএর কোনো মালিকানা নেই; তা একান্তই সরকারের। অর্থাত্ ওই জমি বিজিএমইএ জবরদখল করে আছে। যেকোনো জবরদখলকারীর মতোই বিজিএমইএকে উচ্ছেদ করতে এবং ভবন ভেঙে দিতে সরকার বাধ্য।
রায়ে আরো বলা হয়, ভবনটি নির্মাণ করে বিজিএমইএ বহুপ্রত্যাশিত হাতিরঝিল প্রকল্প বাস্তবায়নে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে তাদের আর্থিক প্রতিপত্তির কারণে; যা কোনো অবস্থায়ই আইনের শাসনের আঙ্গিকে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’ রায়ে ভবনটিকে ক্যান্সারের সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়, ‘এ ধ্বংসাত্মক ভবন অচিরেই বিনষ্ট করা না হলে শুধু হাতিরঝিল নয়, গোটা ঢাকা শহর সংক্রমিত হবে।’বিজিএমইএর সমালোচনা করে রায়ে বলা হয়, ‘আর্থিক পেশিশক্তির অধিকারী বলে শক্তিশালী একটি মহলকে আইনের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে, এমন যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ রায়ে বলা হয়, একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হিসেবে বিজিএমইএর আইনের প্রতি আরো বেশি শ্রদ্ধাশীল হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। তারা তা না করে আইনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে।’
হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর ২০১৩ সালের ২১ মে বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ সুপ্রিম কোটের সংশ্লিষ্ট শাখায় লিভ টু আপিল করে। চলতি বছরের ২ জুন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ বিজিএমইএর লিভ টু আপিল খারিজ করে রায় দেন। উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ঢাকার বিভিন্ন খালের পানিপ্রবাহ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সে সময় বেগুনবাড়ি খালের পাড়ে নির্মিত বিজিএমইএ ভবনটি ভেঙে ফেলার বিষয়টি আলোচনায় আসে।