সহজে বাণিজ্য করা যায় এমন ১৩৬টি দেশ নিয়ে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তালিকা, বাংলাদেশ ৩ ধাপ পিছিয়ে ১২৩তম। সহজে বাণিজ্য করা যায় এমন দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান তিন ধাপ নেমে অবনতি হয়েছে। তার মানে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করা অন্যান্য দেশের তুলনায় আরও কঠিন হয়েছে।
‘এনাবলিং ট্রেড ইনডেক্স (ইটিআই)’ নামের এ সূচকটি তৈরি করেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) ও গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন। ২০১৬ সালের এ সূচকে ১৩৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১২৩তম অবস্থান পেয়েছে। তবে ২০১৪ সালে ১৩৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২০তম। ১ থেকে ৭ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ এ বছর ৩ দশমিক ৪৮ নম্বর পেয়েছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ পেয়েছিল ৩ দশমিক ৩৯ নম্বর। সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে আগের চেয়ে কিছুটা এগিয়েছে ঠিকই, তবে অন্য দেশগুলো আরও বেশি এগিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান পিছিয়েছে।
একটি দেশে আমদানি ও রপ্তানি কতটুকু সহজ, বন্দরের অবস্থা, মানসম্পন্ন পরিবহন-সেবা, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, বাণিজ্য পরিচালনার পরিবেশসহ মোটা দাগে সাতটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে প্রতি দুই বছর পর সূচকটি প্রকাশ করা হয়। এবারের সূচক সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করা যেমন কঠিন, তেমনি ব্যবসা করাও কঠিন। বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসা বা ডুয়িং বিজনেস সূচকে বাংলাদেশ ১৯০টি দেশের মধ্যে ২০১৭ সালের জন্য ১৭৬তম অবস্থান পেয়েছে।
জানতে চাইলে, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, দেশে বিনিয়োগ আনতে হয় অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। মানুষ যেমন একটি পণ্য যাচাই-বাছাই করে কেনে, তেমনি বিনিয়োগকারীরা কোন দেশে বিনিয়োগ করবে, সেটা যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের উন্নতি করতে হবে অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করে। আমরা নিজেরা কতটুকু ভালো করলাম, তা নিয়ে বসে থাকলে হবে না। অন্যদের চেয়ে এগিয়ে যেতে হবে।’
ইটিআইতে দেখা যায়, সহজে বাণিজ্যের দিক দিয়ে প্রতিবেশী ও প্রতিযোগী দেশগুলো বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ১০২তম, পাকিস্তান ১২২, শ্রীলঙ্কা ১০৩, ভিয়েতনাম ৭৩, ভুটান ৯২ এবং নেপালের অবস্থান ১০৮তম। এ তালিকায় শীর্ষ ৫ দেশ সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ডস, হংকং, লুক্সেমবার্গ ও সুইডেন। অন্যদিকে সবার চেয়ে পিছিয়ে আছে ভেনেজুয়েলা। এ সূচকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে বিদেশি বাজারে প্রবেশের সক্ষমতার দিক দিয়ে, অর্থাৎ বাংলাদেশি পণ্যের পক্ষে বিদেশের বাজারে প্রবেশ তুলনামূলক সহজ। সবচেয়ে কম নম্বর পেয়েছে পরিবহন অবকাঠামোর মান ও প্রাপ্যতার দিক দিয়ে।
১৩৬টি দেশের মধ্যে স্থানীয় বাজারে পণ্যের প্রবেশ বা আমদানি সহজীকরণের দিক দিয়ে বাংলাদেশ ১২৭তম, বিদেশের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে ১২, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা বা বন্দরের দক্ষতা ও স্বচ্ছতায় ১৩০, পরিবহন অবকাঠামোর মানে ১০৯, মানসম্পন্ন পরিবহন-সেবার প্রাপ্যতায় ১০০, তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা ও ব্যবহারে ১১২ এবং বাণিজ্য পরিচালনা পরিবেশের দিক দিয়ে ১২৮তম অবস্থান পেয়েছে। এ সূচকে স্থানীয় বাজারে প্রবেশ বলতে আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কহার ও শুল্কের জটিলতা; বিদেশি বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে শুল্কহার; সীমান্ত ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পণ্য খালাসের প্রক্রিয়া, দক্ষতা, নথিপত্র রক্ষা, বাণিজ্যের খরচ ও সময়, ঘুষ ও দুর্নীতি; পরিবহন অবকাঠামোর ক্ষেত্রে বিমান, রেল, বন্দর, রাস্তা, নৌপরিবহনের মান; বাণিজ্য পরিচালনা পরিবেশের ক্ষেত্রে মেধাস্বত্বের সুরক্ষা, সরকারি সংস্থার দক্ষতা ও জবাবদিহি, অর্থায়নের সুযোগ, নিরাপত্তা প্রভৃতি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে, বাংলাদেশে আমদানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে সমস্যার বিষয় হলো শুল্ক ও অশুল্ক বাধা, বন্দরে দুর্নীতি, অভ্যন্তরীণ পরিবহনের খরচ ও দীর্ঘ সময় লেগে যাওয়া, অপরাধ ও চুরি প্রভৃতি। অন্যদিকে রপ্তানির ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো—সম্ভাবনার বাজার ও ক্রেতা খুঁজে পাওয়া, অভ্যন্তরীণ পরিবহনে বেশি খরচ ও দেরি হওয়া, উৎপাদনে কার্যকর প্রযুক্তি ও দক্ষতার অভাব, ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী মান ও পরিমাণ নিশ্চিত করতে না পারা প্রভৃতি। সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নম্বর বেড়েছে। কিন্তু ৩টি দেশের অবস্থান পিছিয়েছে। বাংলাদেশের পাশাপাশি পাকিস্তানের ৩ ধাপ ও শ্রীলঙ্কার ৭ ধাপ অবনতি হয়েছে। অন্যদিকে ভারত এ বছর ৪ ধাপ এগিয়েছে।
জানতে চাইলে, বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সহসভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। এর মধ্যে যারা টিকে থাকতে পারে, তারা ভালো করছে। তিনি বলেন, এসব সমস্যার বিষয়ে আরেকটু যত্নবান হলে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি এখনকার ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২ অঙ্কে নেওয়া সম্ভব।