১৩ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডসের একজন ক্রেতা প্রতিনিধির হাতে এক লাখ পিস ডেনিম বা জিনস প্যান্ট পৌঁছানোর কথা আশুলিয়ার একটি কারখানার। দিন-রাত কাজ করে উৎপাদন কার্যক্রম প্রায় শেষ। শেষ পর্যায়ে এসে আটকে গেল গত দেড় মাসের পরিশ্রমের ফল। ১১ ডিসেম্বর থেকে শ্রমিকদের লাগাতার কর্মবিরতিতে বাকি কাজ শেষ করা যায়নি। কর্মবিরতির দ্বিতীয় দিনে পরিস্থিতি জানতে চায় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। সব কিছু শিগগিরই স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে ক্রেতাকে আশ্বস্ত করলেন কারখানার মালিক। তৃতীয়-চতুর্থ দিনেও একইভাবে ক্রেতাকে বোঝানো হলো। পঞ্চম দিন আর আশ্বাসে কাজ হলো না। শেষ পর্যন্ত এক লাখ পিস ডেনিমের রফতানি আদেশ বাতিল করলেন ক্রেতা। নিজের এবং ক্রেতার নাম গোপন রাখার অনুরোধ জানিয়ে বিজিএমইএর এক পরিচালক এবং ওই কারখানার মালিক সমকালকে বলেছেন, এ ক্ষতির জের টানতে হবে সারা বছর। এ ক্ষতি পূরণ করা কঠিন।
গতকাল সোমবার কাজে যোগ দিয়েছেন পোশাক শ্রমিকরা। অশান্ত আশুলিয়া আবার কর্মমুখর হয়ে উঠেছে। তবে এই কয়েকদিনেই পোশাক শিল্পের যে ক্ষতি হয়েছে, তা অপূরণীয় বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। পোশাক খাতের বড় প্রতিষ্ঠান ওনার্স গ্রুপের মালিক এবং বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন সমকালকে বলেন, শ্রমিকদের কর্মবিরতি কর্মসূচির ওপর প্রথম থেকেই নজর রাখছিলেন ক্রেতারা। কর্মসূচির তৃতীয় দিন থেকে রফতানি আদেশে চুক্তিবদ্ধ দর কমাতে শুরু করেন তারা। কর্মসূচির প্রথম দিনে ১০ সেন্ট, দ্বিতীয় দিন ২০ সেন্ট- এভাবে ধাপে ধাপে পোশাকের ইউনিটপ্রতি দর কমিয়েছেন অনেক ক্রেতা। একপর্যায়ে রফতানি আদেশই বাতিল করেছেন কিছু ক্রেতা। তিনি বলেন, সময় বাড়িয়ে পণ্য পেঁৗছানোর সুযোগ পেয়েছেন যেসব উদ্যোক্তা, তাদের এখন সমুদ্রপথের পরিবর্তে লাখ লাখ ডলার ব্যয়ে আকাশপথে ক্রেতাদের শোরুমে পণ্য পৌঁছাতে হবে।
রফতানিকারকদের দেওয়া তথ্যমতে, চট্টগ্রাম বন্দরে ক্রেতা এজেন্টের কাছে পণ্য বুঝিয়ে দিলে আর কোনো দায়-দায়িত্ব থাকে না উদ্যোক্তার। তবে আকাশপথে পাঠাতে হলে বিমান ভাড়াসহ বিদেশে ক্রেতার ওয়্যারহাউসে পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত সব দায়িত্ব এবং ব্যয় কারখানা মালিকদের বহন করতে হয়। ফলে মুনাফা দূরে থাক, আর্থিক ক্ষতি মেনে নিয়েই ক্রেতার সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হয়।
সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, আশুলিয়ার শ্রম অসন্তোষে লাভবান হবে বিদেশি বিমান পরিবহন সংস্থাগুলো। ক্ষতিতে পড়ল এ দেশের উদ্যোক্তা, শ্রমিক এবং পশ্চাৎসংযোগ শিল্প। ক্ষতিটা দেশেরই হলো। তিনি বলেন, এ ক্ষতি আর্থিক মূল্যে বিচার করা যাবে না। কারণ, অর্থমূল্যের চেয়েও বেশি ক্ষতি হয় দেশের ব্র্যান্ড ইমেজের।
গত দুই সপ্তাহে আশুলিয়ায় বেশ কিছু কারখানা বন্ধ থাকার ক্ষতি কী পরিমাণ দাঁড়াল তার হিসাব এখনও প্রস্তুত করেনি বিজিএমইএ। তবে সংগঠনের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সমকালকে জানান, কারখানাপ্রতি দিনে ক্ষতির পরিমাণ গড়ে সোয়া কোটি টাকা। দুই সপ্তাহ আগে থেকে ৫৫ কারখানায় কাজ হয়নি। শেষ চার দিনে এর সংখ্যা ৫৯-এ দাঁড়ায়।
তৈরি পোশাক খাতে পশ্চাৎসংযোগ শিল্প হিসেবে বিভিন্ন ধরনের এক্সেসরিজ যেমন- কার্টন, বাটন, জিপার, লেবেলসহ ছোট-বড় ৪০টি পশ্চাৎসংযোগ শিল্প আছে। বছরে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার মূল্যের এক্সেসরিজ ব্যবহার করা হয় পোশাক উৎপাদনে। আশুলিয়ায় কারখানা বন্ধ থাকায় এসব শিল্পও পড়েছে বিপদে। এক্সেসরিজ উৎপাদন ও রফতানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন গার্মেন্টস এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিপিএমইএ) সভাপতি আবদুল কাদের খান সমকালকে বলেন, কার্যাদেশ দেওয়ার পর তারা পণ্য উৎপাদন করেছেন। কিন্তু কারখানা বন্ধ থাকায় পোশাক মালিকরা এক্সেসরিজ বুঝে নিচ্ছেন না। দামও পরিশোধ করছেন না। উৎপাদিত পণ্য কারখানায় রাখতেও সমস্যা হচ্ছে। এ কারণে তার সংগঠনের অনেক এক্সেসরিজ প্রতিষ্ঠান বিপদে পড়েছে। তার নিজের কারখানাও এ সংকটে আছে বলে জানান তিনি। শিগগিরই তারা সংবাদ সম্মেলন করে এ ক্ষতির হিসাব তুলে প্রতিকার চাইবেন।
বিভিন্ন সময়ে এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সময়মতো পণ্য পাওয়া নিয়ে অস্বস্তিতে থাকেন বিদেশি ক্রেতারাও। ঢাকায় ক্রেতাদের সংগঠন বায়ার্স ফোরামের পক্ষ থেকে তাদের এ অস্বস্তির কথা জানানো হয়েছে বিজিএমইএকে। সংগঠনের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সমকালকে বলেছেন, বায়ার্স ফোরামের কর্মকর্তারা খুবই উদ্বিগ্ন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, কবে নাগাদ উৎপাদনে ফেরা হবে জানতে চান তারা। তিনি বলেন, বড় ব্র্যান্ডগুলো সারা বছরের পরিকল্পনা করেই রফতানি আদেশ কয়েকটি দেশে ভাগাভাগি করে দেয়। এর মধ্যে কোনো কারখানায় উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটলে ক্রেতাদের পরিকল্পনায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। তারা আদেশ বাতিল করে অন্যান্য দেশে নিয়ে যান।