বাংলাদেশে মোট রফতানি আয়ের ৮১ ভাগের বেশি আসে পোশাক খাত থেকে। সে সুবাদে দ্বিতীয় প্রধান রফতানিকারক দেশের মর্যাদা বাংলাদেশের। পোশাক রফতানিতে বিশ্বে চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দুই কোটি মানুষ এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। গুরুত্বপূর্ণ এ অবদান সত্ত্বেও পোশাক শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়নি। এই খাতের ওপর বার বার আঘাত এসেছে। তাজরীন গার্মেন্টে অগি্নকাণ্ড এবং রানা প্লাজা ধসের পর সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায় পোশাক শিল্প। এরপর রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং হলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলার পর নাজুক অবস্থায় পড়ে খাতটি। এসব ধকল কাটিয়ে পোশাক শিল্প যখন ফের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে ঠিক তখনই আকস্মিকভাবে শুরু হয়েছে শ্রমিক অসন্তোষ। রাজধানীর উপকণ্ঠে আশুলিয়ায় বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের কারণে আবারও সংকটে পড়েছে রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প।
শ্রম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পোশাক খাতের অগ্রযাত্রা নস্যাৎ করার জন্য অসাধু কতিপয় শ্রমিক নেতা ষড়যন্ত্র করছেন। তাদের শনাক্ত করছেন গোয়েন্দারা। আশুলিয়ায় কারখানাগুলোতে কাজের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ১০টি নিয়ন্ত্রণ অফিস খোলা হয়েছে। ওই সব অফিস থেকে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হচ্ছে। গোয়েন্দারা ৭-৮ জন শ্রমিক নেতার নাম পেয়েছেন। তারা নিশ্চিত হয়েছেন, আন্দোলনের নামে ওই সব নেতা শ্রমিকদের উস্কে দিয়ে পোশাক খাতে অরাজকতা সৃষ্টি করছেন। প্রয়োজনে ওই নেতাদের গ্রেফতার করা হবে।
অভিযুক্ত শ্রমিক নেতারা যা বললেন: শ্রমিক নেতাদের বড় একটি অংশ সরকার ও পোশাক মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে বলেছেন, এই আন্দোলনের প্রতি তাদের কোনো সমর্থন নেই। কিন্তু নেপথ্যে তাদের অনেকেই আন্দোলনে ইন্ধন জোগাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার ফেডারেশনের সভাপতি শ্রমিক নেতা বাবুল আক্তার নেপথ্যে থেকে শ্রমিকদের উস্কে দিয়েছেন। কিন্তু এ অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি সমকালকে বলেছেন, ‘এ দাবি অযৌক্তিক। আমি মনে করি এই কর্মবিরতি দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।’ তাহলে শ্রমিকদের কাজে ফেরাতে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না কেন_ এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কর্মবিরতিতে থাকা শ্রমিকরা তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই, এ কারণে তারা কথা শোনে না। তিনি বলেন, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে, তারা প্রকৃত দায়ীদের খুঁজে বের করুক। অতীতেও ২০০৬ এবং ২০১০ সালে শ্রমিক আন্দোলনে তাকে দায়ী করা হয়েছে। তবে অন্যায়ভাবে কারও ওপর দায় চাপিয়ে দিলে সমস্যার সমাধান হবে না। তার সংগঠনের আশুলিয়া আঞ্চলিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, তিনি নিজেও গ্রেফতার আতঙ্কে আছেন।
আন্দোলনের নেপথ্যে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের ইন্ধন রয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে একাধিক সূত্র থেকে। জানতে চাইলে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন সমকালকে বলেন, আন্দোলনে তাদের সমর্থন আছে। তবে কোনো ষড়যন্ত্রে নেই তারা। তিনি স্বীকার করেন, তারাই প্রথম পনের হাজার টাকা নূ্যনতম মজুরির দাবি তুলেছেন। এ নিয়ে আশুলিয়ায় কিছু কর্মসূচিও তাদের ছিল। এ দাবি তোলায় এখন তারা তোপের মুখে পড়েছেন। তিনি জানান, গতকাল তাদের ১০ জন কর্মীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তাদের অবস্থা সম্পর্কে কিছু জানতে পারছেন না তারা।
নিয়ম অনুযায়ী মজুরি বৃদ্ধির দাবি না তুলে হঠাৎ কর্মবিরতিতে যাওয়াকে ষড়যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে সরকার এবং মালিকদের পক্ষ থেকে। এমনকি শ্রমিক নেতারাও এ আন্দোলনকে বৈধ মনে করছেন না_ এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রতন বলেন, নিয়মিত পথেই তারা হেঁটেছেন। কয়েক মাস আগে মজুরি ১৫ হাজার টাকার দাবিতে শ্রম প্রতিমন্ত্রী, শ্রম অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি কার্যালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছেন তারা। ওই স্মারকলিপি জমা নেওয়ার ফটোকপি আছে তাদের কাছে। এখন সরকার অস্বীকার করছে। তাহলে কি আন্দোলনে আপনারাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শ্রমিকরা নিজেরাই আন্দোলনে নেমেছেন। কারণ, প্রতি বছরই জানুয়ারি এলে বাড়ি ভাড়া বাড়ে ,অন্যান্য ব্যয়ও বেড়ে যায়।
শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিলের সভাপতি শ্রমিক নেতা আমিরুল ইসলাম আমিনেরও ইন্ধন রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে। সমকালের সঙ্গে আলাপকালে তা অস্বীকার করেন তিনি। তিনি বলেন, মজুরির বিষয়টি অবশ্যই ভাবতে হবে। তবে মজুরি আদায়ের একটা পদ্ধতি আছে, সে পথে না গিয়ে যেভাবে শ্রমিকরা হঠাৎ কর্মবিরতি চালিয়ে যাচ্ছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা আন্দোলন করি প্রকাশ্যে। নেপথ্যে কিছু করি না। তবে আশুলিয়ার ঘটনায় নেপথ্যে যদি কেউ থাকে, তাদের খুঁজে বের করা দরকার। শ্রমিকদের কাজে ফেরাতে কেন নেতা হিসেবে প্রভাব খাটাচ্ছেন না_ জবাবে তিনি বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে সব কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন নেই, এই কারণে শ্রমিকরা তাদের কথা শুনছে না।
কাজে ফিরতে চান শ্রমিকরা :শ্রমিকদের কাজে ফিরিয়ে আনতে গতকালও চেষ্টা ছিল। এ লক্ষ্যে চার মন্ত্রীর সমন্বয়ে গঠিত কমিটির প্রধান নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান গতকাল শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় গার্মেন্টস শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে নেতারা বলেছেন, শ্রমিকরা কাজে ফিরতে চান। চাকরিচ্যুতি কিংবা কোনো রকম হয়রানি করা যাবে না। এরকম নিশ্চয়তা পেলে তারা কাজে যোগ দেবেন। বৈঠক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বৈঠকে উপস্থিত শ্রমিক নেতা সিরাজুল ইসলাম রনি সমকালকে জানান, শ্রমিকরা কাজে ফিরতে চায়_ এ মর্মে কারখানা মালিক বরাবরে লিখিত আবেদন করা হবে। আবেদনপত্রগুলো শ্রমিক নেতারা সংগ্রহ করে কারখানা মালিকের হাতে পেঁৗছে দেবেন। দুই-একদিনের মধ্যে আবেদন সংগ্রহের কাজ শুরু হবে। বৈঠকে নৌপরিবহনমন্ত্রী বলেন, একটি মহল আশুলিয়ার শ্রমিকদের বিভ্রান্ত করে আন্দোলনে নামিয়েছে। তাদের হঠকারী আন্দোলনের কারণে ট্রেড ইউনিয়ন ব্যবস্থা বিতর্কিত হচ্ছে। তিনি বলেন, এখন কারখানার মালিকদের বলার আগে শ্রমিকদের কাছ থেকে কারখানা খুলে দেওয়ার অনুরোধ আসতে হবে। বৈঠকে শ্রমিক নেতাদের মধ্যে আবুল হোসেন, বাবুল আক্তার, সিরাজুল ইসলাম রনি, নাজমা আক্তার, বাহারানে সুলতান বাহার, লিমা ফেরদৌসী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আন্দোলনের শুরু থেকেই পোশাক মালিকরা বলে আসছেন, এ মুহূর্তে বেতন বৃদ্ধির দাবি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। তথাকথিত কিছু শ্রমিক নেতা আন্দোলনের নামে উস্কে দিচ্ছেন শ্রমিকদের। পোশাক শিল্পের সঙ্গে ওই সব নেতার কোনো সম্পর্ক নেই। নিজেদের স্বার্থ আদায়ে সাধারণ শ্রমিকদের উস্কে দিয়ে পোশাক শিল্পকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। পোশাক মালিকরা আরও জানান, প্রধান দুই রফতানি বাজার ইউরোপ ও আমেরিকায় আগামী বসন্ত মৌসুমকে কেন্দ্র করে পোশাক কারখানাগুলোতে চলছে এখন রাত-দিনের ব্যাপক উৎপাদন কর্মযজ্ঞ। এ অবস্থায় পোশাক খাতে আকস্মিক কর্মবিরতির ফলে রফতানির আদেশ বাতিল হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সাশ্রয়ী দাম, ভালো মানের পোশাক ও কর্মপরিবেশের সংস্কারসহ নানান উদ্যোগের ফলে এ বছর রফতানি আদেশ তুলনামূলক বেশিই পেয়েছে বাংলাদেশ। ঠিক এ রকম মুহূর্তে আশুলিয়া অঞ্চলে সবচেয়ে ভালো মানের কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের কর্মবিরতি দেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা।
আশুলিয়ার পোশাক শ্রমিকদের কর্মবিরতিকে বেআইনি উল্লেখ করে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ গতকাল বিবিসিকে জানিয়েছেন, এই আন্দোলন অপ্রত্যাশিত। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অবস্থা ভালো। রানা প্লাজা ধসের ধাক্কা সামলে কারাখানায় ভালো পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। রফতানিও বাড়ছে। এ অবস্থায় আকস্মিক শ্রমিক ধর্মঘট সেটা নষ্ট করবে। বহির্বিশ্বের কাছে আবার আমাদের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে। পাঁচ বছর পর পর মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়। দুইবার এই বোর্ড গঠন করা হয়েছে। সর্বশেষ মজুরি বোর্ড গঠনের মেয়াদ পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কোনো নতুন বোর্ড গঠন করা হবে না। সত্যিকার অর্থে আমাদের কারখানার প্রকৃত শ্রমিকদের মধ্যে কোনো অসন্তোষ নেই। কিছু বহিরাগত এনজিওর মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে এটা করছে। পোশাক মালিকদের সংগঠনের নেতারা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন, শ্রমিকরা কাজ করলে বেতন পাবে; না করলে পাবে না। দরকার হলে তারা কারখানা বন্ধ রাখবেন। তাই বলে শ্রমিকের অন্যায় দাবির কাছে তারা মাথা নত করবেন না।
যোগাযোগ করা হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সমকালকে বলেন, যারা আন্দোলনের নামে পোশাক শিল্পকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ওইসব এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে যা যা করণীয় সরকার তাই করবে। শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, এ ধরনের আন্দোলন দেশের বিরুদ্ধে প্রচ্ছন্ন ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রের প্রমাণ হিসেবে তিনি বলেন, শ্রমিক নেতারাই বলছেন এ ধরনের আন্দোলন অযৌক্তিক। এই আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিক নেতাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে এর নেপথ্যে কারা?
বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সমকালকে বলেন, রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি থাকলেও মুনাফা কমেছে। কারণ, একদিকে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, অপরদিকে পোশাকের দর কমিয়েছেন বিদেশি ক্রেতারা। এরকম নাজুক অবস্থায় ষড়যন্ত্র হলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হবে না। বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এবং এফবিবিসিআইর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, পোশাক খাতের বিরুদ্ধে বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই আশুলিয়ায় শ্রমিকদের অযৌক্তিক কর্মবিরতি চলছে। বিজিএমইএর সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু সমকালকে বলেন, গুলশানের হলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলার পর পোশাক খাত আরেক দফা ঝুঁকিতে পড়ল।