২২ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুর থেকে গার্মেন্ট শিল্পের কাঁচামাল (হ্যাংগার, বোতাম ও সুতা) ঘোষণায় আমদানি নিষিদ্ধ ওষুধ ও প্রসাধনী পণ্য নিয়ে আসে কুমিল্লা ইপিজেড এলাকার প্রতিষ্ঠান ক্যাট গার্মেন্টস লিমিটেড। চালানের আগামপত্র (বিল অব এন্ট্রি-২৩২৯৪৮) জমা দেয় খালাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান খলিল ট্রেডার্স। রফতানি পণ্যের কাঁচামাল আমদানির ঘোষণা থাকায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য দ্রুত খালাসের ছাড়পত্র পায় প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু গোপন তথ্যের ভিত্তিতে চালানের ছাড়করণ সাময়িকভাবে স্থগিত করে শতভাগ কায়িক পরীক্ষা চালায় চট্টগ্রাম কাস্টমসের এআইআর শাখা। এতে দেখা যায়, প্রায় সাড়ে তিন হাজার কেজি ওজনের ২৮ ধরনের আমদানি নিষিদ্ধ ওষুধ ও ৩ হাজার ৪৭৩ কেজি প্রসাধনী পণ্য নিয়ে এসেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এর চারদিন আগে ১৮ ডিসেম্বর একই এলাকার প্রতিষ্ঠান কাদেরা স্কোর্টসওয়্যার লিমিটেডও তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল ঘোষণায় প্রায় ১৩ কোটি টাকার সিগারেট নিয়ে আসে। আমদানি নথি জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব (৬০২ শতাংশ শুল্ক হারে) ফাঁকি দিয়েছিল প্রায় ৭৮ কোটি টাকার। আমদানিকারকের পক্ষে চালান (বিল অব এন্ট্রি নম্বর- ২৩৫০২৬) খালাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ছিল ‘সারাচেন করপোরেশন’।
এভাবে রফতানিমুখী খাত হিসেবে তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে দেয়া শুল্কমুক্ত ও দ্রুত পণ্য ছাড়করণসহ নানা সুবিধার অপব্যবহার করে মিথ্যা ঘোষণায় সিগারেট, প্রসাধনী, আমদানি নিষিদ্ধ ওষুধ ও ইলেকট্রনিকসের মতো বাড়তি শুল্কযোগ্য পণ্য নিয়ে আসছেন আমদানিকারকরা। এভাবে আমদানি নথি জালিয়াতির মাধ্যমে দেড় শতাধিক গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, তৈরি পোশাক শিল্পে বিভিন্ন সময় কাঁচামাল আমদানির আড়ালে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া ১২০ প্রতিষ্ঠানের তালিকা করেছেন শুল্ক কর্মকর্তারা। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার (রিস্ক ম্যানেজমেন্ট) আওতায় এসব প্রতিষ্ঠানের চালানগুলোর ওপর বিশেষভাবে নজরদারি চালানো হচ্ছে। এর বাইরেও চলতি বছর আরো অন্তত ৩৬টি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নথি জালিয়াতির মাধ্যমে ৪৫ থেকে ৬০২ শতাংশ শুল্কযুক্ত বিভিন্ন পণ্য আমদানি ও রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছেন শুল্ক কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার রেজাউল হক এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, সাধারণত তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে কায়িক পরীক্ষা চালানো হয় না। একই সঙ্গে আমদানিকারকদের দেয়া হয় চালান দ্রুত ছাড়করণের সুবিধা। এসব কাঁচামালে উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রফতানি করা হয় বলে এগুলোর ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত আমদানি ছাড়াও অন্যান্য বাড়তি সুবিধা দেয়া হয়। তাই বাড়তি শুল্কযুক্ত পণ্য বা আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের কায়িক পরীক্ষা এড়ানোর জন্যই গার্মেন্টসের কাঁচামাল আমদানির মিথ্যা ঘোষণা দেয় কিছু প্রতিষ্ঠান। এছাড়া শুল্ক ফাঁকি দিতেও এ ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে তারা। কাস্টমস কর্মকর্তাদের তত্পরতা বাড়ায় সম্প্রতি এ ধরনের বেশকিছু অনিয়ম ধরা সম্ভব হয়েছে বলে আরো জানিয়েছেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট মামলার নথি বিশ্লেষণে দেখা যায়, গার্মেন্টসের কাঁচামাল ঘোষণায় আমদানিতে রাজস্ব ফাঁকি দিতে চার ধরনের মিথ্যা তথ্য দিচ্ছেন আমদানিকারকরা। এগুলো হলো— আমদানি পণ্যের পরিচিতি তালিকা (এইচএস কোড) পরিবর্তন, ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য আমদানি, সিপিসি (কাস্টমস প্রসিডিউর কোড) পরিবর্তন ও নথি জালিয়াতির মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে এইচএস কোড পরিবর্তন বা ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য আমদানির ঘটনায়।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম কাস্টমসের এআইআর শাখার কর্মকর্তারা গার্মেন্টসের কাঁচামাল ঘোষণায় আসা বিদেশী সিগারেটের একটি চালান আটক করেন গত ১৫ জুন। ওই চালানে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হচ্ছিল ২৯ কোটি টাকার। নারায়ণগঞ্জের আরএজেড অ্যাপারেল লিমিটেডের চালানটি খালাসের (বিল অব এন্ট্রি নং-৭২১৪৩৭) দায়িত্বে ছিল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট রাইয়ান ট্রেডিং লাইন। এছাড়া চলতি বছরের মার্চে গার্মেন্টসের সুতা ঘোষণায় সিগারেট আমদানির মাধ্যমে সাড়ে ৪৩ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেয় জেনেটিক ফ্যাশন লিমিটেড। ২৫ ফেব্রুয়ারি আসা এ ধরনের আরেকটি চালানে ২৮ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেয় ‘এফআরসি নিট কম্পোজিট’।
এছাড়া ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার আওতায় বিভিন্ন সময় পাঁচ থেকে ১৫টি মামলা হয়েছে এমন গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে গ্যালাক্সি সোয়েটার অ্যান্ড ইয়ার্ন ডায়িং লিমিটেড, ফ্যাশন ক্রাফটস অ্যান্ড ডিজাইন লিমিটেড, লিজ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, লিটন ফ্যাব্রিকস লিমিটেড, ফ্যাশন নিট গার্মেন্টস লিমিটেড, এইচআর টেক্সটাইল লিমিটেড ও হামজা টেক্সটাইল লিমিটেড। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলার পাশাপাশি জরিমানা করা হয়েছে ১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এছাড়া একাধিক চালানে অনিয়মের তথ্য পাওয়ায় মামলাসহ জরিমানা করা হয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে— কেয়া নিট কম্পোজিট লিমিটেড, ইউনিলাইন্স টেক্সটাইল লিমিটেড, বার্ড এ অ্যান্ড জেড লিমিটেড, এসএম নিটওয়্যার লিমিটেড, চৈতি কম্পোজিট লিমিটেডসহ ২১টি প্রতিষ্ঠান।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার মু. রইস উদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ সম্প্রতি তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ঘোষণা দিয়ে বেশি শুল্কের পণ্য নিয়ে আসার ঘটনা বাড়ছে। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের চালান আটক করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে গ্রহণ করা হচ্ছে বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা।