পোশাকসহ উৎপাদনমুখী সব খাতের কল-কারখানায় কর্মরতদের জীবনের ঝুঁকি যাচাই-বাছাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ যাচাই-বাছাইয়ের ভিত্তিতে বিভিন্ন খাতের শিল্পকারখানার জন্য অভিন্ন পরিদর্শন তালিকা (চেকলিস্ট) প্রণয়ন করা হয়েছে। চেকলিস্ট অনুযায়ী এরই মধ্যে পরিদর্শন কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। সাম্প্রতিককালে শিল্পকারখানায় ঘটে যাওয়া একের পর এক দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের উদ্দেশ্যে এ উদ্যোগ হাতে নিয়েছে সরকার। দেশে গত তিন দশকে শিল্পায়নের জোয়ারে উৎপাদনমুখী অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানার শ্রমিকরা দিনের অনেকটা সময় পার করছেন যন্ত্রের সঙ্গে। অনেক ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার সময় প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর কারণেও তাদের জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এর পরও এসব কলকারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা বিধান করা যায়নি। তবে ধারাবাহিক শিল্প দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তত্পর হয়েছে সরকার। এত দিন শুধু পোশাক খাতের কল-কারখানার ঝুঁকি ও নিরাপত্তার বিষয়টিকে নির্ধারিত ছকে যাচাই-বাছাই করা হতো। এখন থেকে পোশাকসহ উৎপাদনমুখী সব খাতের কলকারখানায় অভিন্ন পরিদর্শন তালিকার ভিত্তিতে ঝুঁকি ও নিরাপত্তা যাচাই-বাছাই করা হবে। প্রচলিত শ্রম আইনে দেশের সব শিল্পকারখানায় কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) নিয়মিত পরিদর্শন কার্যক্রম চালানোর বিধান রয়েছে। তবে জনবল সংকটের কারণে এ পরিদর্শন প্রক্রিয়ায় ঘাটতিও ছিল। অন্যদিকে কারখানা কিংবা কর্মপরিবেশের সার্বিক নিরাপত্তা যাচাইয়ের জন্য নির্ধারিত ছক বা চেকলিস্ট ছিল শুধু পোশাক খাতের জন্য। ধারাবাহিক শিল্প দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি ডিআইএফইকে আরো কার্যকর করে তোলার পদক্ষেপ নেয়া হয়। এজন্য পরিদর্শকও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আবার সব খাতের কারখানা পরিদর্শনের জন্য একটি অভিন্ন পরিদর্শন চেকলিস্টও তৈরি করা হয়েছে। এ চেকলিস্টের মাধ্যমে পোশাকসহ দেশের সব শিল্প খাতের কারখানায় কর্মরত শ্রমিকের পেশাগত নিরাপত্তার আওতায় জীবনের ঝুঁকি যাচাই করা হবে। পরিদর্শনের মাধ্যমে এ যাচাই প্রক্রিয়া কঠোরভাবে পরিপালনের পর যথাযথ ব্যবস্থাও নেয়া হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডিআইএফইর মহাপরিদর্শক সৈয়দ আহম্মদ বণিক বার্তাকে বলেন, মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষামূলক ব্যবহার ও সব খাতের সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতে চেকলিস্টটি তৈরি করা হয়েছে। চেকলিস্ট অনুযায়ী এরই মধ্যে পরিদর্শন কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। আশা করছি, কারখানার কর্মপরিবেশ ও শ্রমনিরাপত্তা জোরদারে আরো কঠোর ও শক্তিশালী ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে। জানা গেছে, প্রায় এক বছর ধরে সব খাতের জন্য একটি অভিন্ন পরিদর্শন চেকলিস্ট প্রণয়নের কাজ করে আসছিল ডিআইএফই। অধিদপ্তরের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কারিগরি সহায়তায় সম্প্রতি এ চেকলিস্ট প্রণয়নের কাজ শেষ হয়। সমন্বিত চেকলিস্টের ভিত্তিতে ডিআইএফইর পরিদর্শকদের কলকারখানা পরিদর্শনের নির্দেশ দেয়া রয়েছে। ১ জানুয়ারি থেকে সমন্বিত চেকলিস্ট ব্যবহারের মাধ্যমে পরিদর্শন কার্যক্রমও শুরু করেছেন পরিদর্শকরা। এরপর ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ভিন্ন চেকলিস্ট প্রণয়ন করা হবে। জানা গেছে, উল্লিখিত চেকলিস্টের অংশ মূলত দুটি। প্রথম অংশে রয়েছে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ, উৎপাদিত পণ্য, কাঁচামাল, জনবল ইত্যাদি ও নির্মাণ-সম্পর্কিত তথ্য। দ্বিতীয় অংশে রয়েছে আইনের বিধান ও প্রচলিত প্রথাভিক্তিক ১২৫টি প্রশ্নের একটি প্রশ্নমালা। এ প্রশ্নমালা চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো— সাধারণ, গুরুত্বপূর্ণ, অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ চার ভাগে নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলি, যন্ত্র ও চলাচলের পথে জীবনের নিরাপত্তার ঝুঁকি, শিশু ও কিশোর শ্রমিক, প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা, দুর্ঘটনা, ক্ষতিপূরণ ও সেফটি কমিটি, কল্যাণমূলক ব্যবস্থা, কর্মঘণ্টা ও ছুটি, মজুরি ও মজুরি পরিশোধ, সামাজিক নিরাপত্তা, বৈষম্য এবং কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা-সংক্রান্ত প্রশ্ন। এর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে রয়েছে শ্রমিকের কাজের ধরন ও প্রকৃতির ভিত্তিতে পদবির শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী নিয়োগপত্র দেয়া, শিশু শ্রমিক নিয়োগ, আইন মোতাবেক নারীদের মাতৃত্বকালীন সুবিধা যথাযথভাবে পরিশোধসহ মাতৃত্বকালীন ছুটি দেয়া, শ্রমিকদের জন্য প্রত্যেক ফ্লোরে সুবিধাজনক স্থানে নিরাপদ ও পর্যাপ্ত সুপেয় পানির ব্যবস্থা-সংক্রান্ত্র প্রশ্নমালা। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নমালায় কলকারখানার পেশাগত নিরাপত্তা ঝুঁকি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য যেসব প্রশ্ন রাখা হয়েছে সেগুলো হলো— প্রতিষ্ঠানের ভবন, ভবনের অংশবিশেষ, চলাচলের পথ বা যন্ত্রের জীবনের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণতা, যেখানে ২০ জনের বেশি শ্রমিক কাজ করেন, সেখানে কমপক্ষে দুটি করে বহির্গমন পথের উপস্থিতি, বহির্গমনসহ চলাচলের পথ, সিঁড়ি ও মেঝের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রতিবন্ধকতামুক্ততা, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের পর্যাপ্ততা ও নির্ধারিত স্থানে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের কার্যকর প্রস্তুতি-বিষয়ক প্রশ্ন। এছাড়া সব মেশিন ও সরঞ্জামের বিপজ্জনক অংশ এবং বৈদ্যুতিক জেনারেটর, মোটর বা রোটারি কনভার্টারের সব অংশ চালু থাকা কিংবা ব্যবহারের সময় এগুলোকে দৃঢ় ও নিরাপত্তামূলকভাবে ঘিরে রাখা হয় কিনা, তাও জানতে চাওয়া হয়েছে এতে।
সব খাতের কল-কারখানায় জীবনের ঝুঁকি যাচাই হচ্ছে
অভিন্ন পরিদর্শন চেকলিস্ট প্রণয়ন করেছে সরকার