দেশে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে মালিকদের ওপর চাপ বাড়ছে। গত ডিসেম্বরে আশুলিয়ার শ্রমিক আন্দোলনের পর বিদেশি ব্র্যান্ড ও ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড মজুরি বোর্ড গঠন করতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করে চিঠি দেওয়ায় সে চাপ আরও বেড়েছে। অবশ্য চাপের বিষয়টি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতারা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে চাইছেন না। উল্টো ব্র্যান্ড ও অ্যাকর্ডের চিঠি দেওয়ার নৈতিকতা ও এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাঁরা বলছেন, গতবার মজুরি বাড়ানোর পর নামীদামি প্রতিষ্ঠানগুলো পোশাকের দাম এক সেন্টও বাড়ায়নি, বরং কমিয়েছে। তাই তাদের মুখে মজুরি বাড়ানোর কথা মানায় না। আর অ্যাকর্ড শুধু কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে চুক্তিবদ্ধ, শ্রমিক অধিকার নিয়ে তাদের মাথাব্যথা এখতিয়ারবহির্ভূত। অন্যদিকে শ্রমিকনেতা ও শ্রমিক অধিকার নিয়ে কর্মরত ব্যক্তিরা বলছেন, শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোটা সময়ের দাবি। বর্তমান পরিস্থিতিতে মজুরি পুনর্বিবেচনার উদ্যোগ না নিলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। ক্রেতা ও নামীদামি প্রতিষ্ঠানগুলোর চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে, বিজিএমইএর সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, অ্যাকর্ডের চিঠি দেওয়ার এখতিয়ার নেই। আর ক্রেতারা না বুঝেই চিঠি দিয়েছেন। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা এমনটি করেছেন। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, কারখানাভিত্তিক কয়েকটি দাবি নিয়ে আশুলিয়ায় আন্দোলন শুরু হয়। পরে সেটি মজুরির দিকে চলে যায়। আসলে পোশাকশিল্পে যারা গন্ডগোল করে, তারা সব সময়ই মজুরিকে ইস্যু করে। এ জন্য মজুরি বাড়ালেই এই সমস্যার সমাধান হবে না। জানতে চাইলে, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বলেন, অ্যাকর্ড ২০০ ব্র্যান্ডের মুখপাত্র। তারা কার পক্ষ হয়ে কথা বলছে, সেটি যদি সরকার ও মালিকেরা না বোঝেন, তাহলে বলার কিছু নেই। অন্যদিকে ক্রেতারা হয়তো এখন স্বাভাবিকভাবে বলছেন, পরে কঠোর অবস্থানে যেতে পারেন। তবে তাঁরাই জানেন শেষ পর্যন্ত তাঁরা কী করবেন। মজুরি বাড়ানোসহ বেশ কিছু দাবি আদায়ে গত ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে আশুলিয়ার কয়েকটি কারখানার পোশাকশ্রমিকেরা ধর্মঘট শুরু করেন। একপর্যায়ে আন্দোলন আশপাশের অন্যান্য কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে। তখন সরকার, মালিক ও শ্রমিকনেতারা উদ্যোগ নিয়েও কোনো সমাধান করতে পারেননি। আন্দোলন থামাতে ৫৯টি কারখানা বন্ধ করে দেয় বিজিএমইএ। একই সঙ্গে নয়টি মামলা করেন কারখানার মালিক ও পুলিশ প্রশাসন। এসব মামলায় শ্রমিকনেতাসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ছাড়া দেড় হাজারের বেশি শ্রমিককে ছাঁটাই করে কয়েকটি কারখানা। চার দিন বন্ধ থাকার পর কারখানা খুলে দেওয়া হলেও এখনো শ্রমিক ও শ্রমিকনেতারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আশুলিয়ার ঘটনার পরপরই ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইনসহ ২৬টি আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন বিশ্বখ্যাত এইচঅ্যান্ডএম, গ্যাপ, ইন্ডিটেক্স, নেক্সট, সিঅ্যান্ডএমসহ বাংলাদেশ থেকে পোশাক কেনে এমন দুই ডজন বিদেশি ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানকে এখানকার শ্রমিক অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার হতে অনুরোধ করে চিঠি দেয়। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এইচঅ্যান্ডএমসহ ২০টির বেশি ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠিটি দেয়। সুইডেনভিত্তিক খুচরা বিক্রেতা এইচঅ্যান্ডএম বিবৃতি দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছে। চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীর মনোযোগ আকর্ষণ করে শ্রম অধিকার নিশ্চিত করার অনুরোধ করে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো। একই সঙ্গে তারা নিয়মিত মজুরি পর্যালোচনারও দাবি জানায়। চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পোশাকশ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে। সরকার মজুরি পর্যালোচনা করে পোশাকশিল্পে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করতে পারে। এদিকে নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ। ১১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আরেকটি চিঠি দিয়ে এ আহ্বান জানায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুই শতাধিক ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের এই জোট। চিঠিতে অ্যাকর্ড বলেছে, মজুরি বোর্ড গঠনের পাশাপাশি তা যদি নিয়মিত পর্যালোচনার একটি ব্যবস্থা করা হয়, তবে তা পোশাক খাতে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে সহায়তা করবে। এর মাধ্যমে একই সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে পোশাক খাতে যে অনভিপ্রেত ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে, তাও এড়ানো সম্ভব হবে। এ ধরনের পরিস্থিতি শিল্পের ভাবমূর্তি ও আস্থা ক্ষুণ্ন করে। বিজিএমইএর একাধিক নেতা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে আশুলিয়ার শ্রম আন্দোলন বন্ধে কঠোর পদক্ষেপে সফলতা পাওয়া গেছে। তবে ব্র্যান্ড, ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ও অ্যাকর্ডের উদ্যোগের কারণে মজুরি নিয়ে নতুন করে চাপ তৈরি হচ্ছে, এটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। শেষ পর্যন্ত এটি কোথায় গিয়ে থামবে, এখনই তা বলা যাচ্ছে না। দেশের পোশাকশিল্পে বর্তমানে ন্যূনতম মজুরি ৫ হাজার ৩০০ টাকা। এর মধ্যে মূল মজুরি ৩ হাজার টাকা। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে এই মজুরিকাঠামো বাস্তবায়িত হয়। তার আগে ন্যূনতম মজুরি ছিল ৩ হাজার টাকা। শ্রম আইন অনুযায়ী, মজুরি ঘোষণার এক বছর পর ও তিন বছরের মধ্যে মজুরি পুনর্নির্ধারণের সুযোগ আছে। পাঁচ বছর পরপর মজুরি বোর্ড গঠিত হবে। তবে সরকার প্রয়োজন মনে করলে যেকোনো সময় মজুরি বোর্ড গঠন করতে পারে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘বৈশ্বিক পোশাক খাতে নিম্নতম মজুরি-২০১৫’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি এখন ৬৮ ডলার, ভারতে ৭৮, ইন্দোনেশিয়ায় ৯২, পাকিস্তানে ৯৯, কম্বোডিয়ায় ১২৮ এবং মালয়েশিয়ায় ২২৫ ডলার। নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করার দাবিতে গত মাসের শেষের দিকে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হককে স্মারকলিপি দেয় ১২টি শ্রমিক সংগঠনের জোট গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলন। এতে মূল মজুরি ১০ হাজার টাকা, বাড়ি ভাড়া ৪ হাজার টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৫৭০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ৭৮০ টাকা, টিফিন ভাতা ৬৫০ টাকাসহ মোট ১৬ হাজার টাকা দাবি করা হয়। আশুলিয়ার ঘটনার আগেও নিম্নতম মজুরি বোর্ড, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর কাছে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে স্মারকলিপি দিয়েছিল এই জোট। তবে কোনো পক্ষই বিষয়টি আমলে নেয়নি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখ্তার বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম ও বাসা ভাড়া হিসাব করেই আমরা ১৬ হাজার টাকা মজুরি দাবি করেছি। বর্তমান বাজারে বেঁচে থাকার জন্য এই মজুরি যৌক্তিক। এখন দাবি নিয়ে আলোচনা করতে আমরা সবার সঙ্গে বসতে চাই। কমবেশি যা হোক, মজুরি বৃদ্ধি করাটা প্রয়োজন।’বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, তিন বছর ধরে শ্রমিকদের ৫ শতাংশ করে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট দিচ্ছেন মালিকেরা। ফলে এখনই মজুরি বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা নেই। তা ছাড়া সব বাজারেই বর্তমানে মন্দা চলছে। মজুরি বাড়ানোর কারণে যদি মালিকের সক্ষমতা না থাকে এবং কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে শ্রমিকেরাই চাকরি হারাবেন। শ্রমিকনেতা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘বার্ষিক ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দিয়ে শ্রমিকের কিছুই হয় না। গতবারের মজুরি বোর্ডে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। মালিকপক্ষের যুক্তি ছিল, বড় কারখানাগুলো পারবে না। গত তিন বছরে ছোট আকারের অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন ইনক্রিমেন্ট বাড়াতে সমস্যা হওয়ার কথা না।’ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেন, ‘মজুরি বাড়বে কি বাড়বে না, সেটি বড় কথা না। শ্রমিকদের দাবি নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার বলে মনে করি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আলোচনার কোনো উদ্যোগ নাই। একের পর এক মামলা হয়েছে। শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। আলোচনা না হলে একটি গুমোট অবস্থা থেকেই যাবে। এটি কোনোভাবেই শিল্পের জন্য স্বাস্থ্যকর ব্যাপার না।’