দিনে দিনে সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনের সাথে সাথে পাল্টে গেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো। এটা আরোপিতভাবে নয়, স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থনীতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। কৃষি নির্ভর অর্থনীতি ছিল এক সময়ে এ অঞ্চলে। কিন্তু সেই কৃষি নির্ভর অর্থনীতি থেকে ক্রমশ বেরিয়ে এসে শিল্প ও সেবা খাতমুখী হয়েছে আমাদের অর্থনীতি। এখন আর অর্থনীতিতে কৃষির একচ্ছত্র দাপট নেই আগের মত। এক সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির পর্যালোচনা করেছিল বিশ্বব্যাংক। ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছিল ৭০-এর দশকের বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিচিত্র। যেখানে বলা হয়েছিল, ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উত্পাদনে (জিএনপি) কৃষি খাতের অবদান ছিল ৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ। আর শিল্প ও সেবা খাতের অবদান যথাক্রমে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ ও ৩৪ শতাংশ। পাকিস্তানি শাসক চক্রের শোষণ বঞ্চনায় তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান ছিল উন্নয়নের ছোঁয়া বঞ্চিত। এখানকার আয় দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালানো হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক চক্রের চরম অনীহা প্রকাশ পেয়েছে। অভাব, দুঃখ, দারিদ্র্য ছিল এখানকার মানুষের নিত্যসঙ্গী। স্বাধীনতার পর বিগত ৪৫ বছরে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিগুলো পাল্টেছে। ক্রমশ শিল্প ও সেবার খাতের বিকাশ হয়েছে। এর ফলে অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো অনেকটাই বদলে গেছে। সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরের হিসাবে, মোট দেশজ উত্পাদনের (জিডিপি) তিনটি খাতের মধ্যে কৃষি খাতের অবদান তৃতীয় স্থানে। সেবা খাতের অবদান শীর্ষে। গত অর্থবছরে জিডিপিতে সেবা খাতের অবদান ছিল ৫৩ দশমিক ১২ শতাংশ। আর কৃষি খাতের অবদান কমতে কমতে ১৫ দশমিক ৩৫ শতাংশে নেমে এসেছে। শিল্পখাত জোগান দিয়েছে ৩১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। সময়ের আবর্তনে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকারও বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকগুণ। স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে এদেশের অর্থনীতির আকার ছিল অনেক ছোট। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেক পালাবদল ঘটেছে। নানা চড়াই-উতরাই ধাপ অতিক্রম করে বর্তমানে আমাদের অর্থনীতি একটি ভালো পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় উঠে এসেছে এদেশ। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৭০ সালে এ দেশের অর্থনীতিতে মোট জাতীয় উত্পাদনের (জিএনপি) আকার ছিল মাত্র ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার। তত্কালীন সময়ে মুদ্রা বিনিময় হার ছিল প্রতি ডলারে ৭ টাকা ২৮ পয়সা। সেই হিসাবে, অর্থনীতির আকার দাঁড়ায় ৩ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের স্থিরমূল্যে দেশের অর্থনীতি বা জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৮৩ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় এখন ১৪শ’ ডলার ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশের নানা দিক বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয়ই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং তা হলো আমাদের অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশেও একটি ছোটখাটো শিল্প বিপ্লব হয়েছে। এখানে শিল্পখাতের অবদান কয়েকগুণ বেড়েছে। শিল্প বিপ্লবের ৮০ বছরে ইংল্যান্ড জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ২০ শতাংশ থেকে ৩৩ শতাংশ উন্নীত করেছিল। সেই আলোকে বলা চলে বাংলাদেশেও একটি ছোট-খাটো শিল্প বিপ্লব হয়েছে। আমাদের অর্থনীতি আগের মত আর কৃষি নির্ভর নেই। অর্থনীতিতে কৃষি খাতের অবদান কমলেও উত্পাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বাড়লেও খাদ্য ঘাটতি হয়নি। এটিও বড় সাফল্য। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের উন্নয়ন বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৫০১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশই ছিল বিদেশি সহায়তা নির্ভর। এখন সেই চিত্রটি পুরোপুরি পাল্টে গেছে। এখন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৩০ শতাংশের মতো জোগান আসে বিদেশি সহায়তা থেকে। আগে যে রাজস্ব আদায় হতো, তার ৭০ শতাংশই আসত শিল্প আমদানি পর্যায় থেকে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে এক পণ্যনির্ভর রপ্তানি খাতের চিত্র পাল্টায়নি। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত গড়ে বছরে ৪২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। এর মধ্যে পাট ও পাটজাত পণ্যের পরিমাণ ছিল গড়ে প্রায় ২৭ কোটি ডলার, যা মোট রপ্তানির ৬৫ শতাংশ। তখনও একটি মাত্র পণ্যের ওপর রপ্তানি খাত নির্ভরশীল ছিল। তখন বিশ্বব্যাংক মন্তব্য করেছিল, বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের পুনর্জাগরণ দরকার। পাটের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর সুপারিশ করে বিশ্বব্যাংক আরো বলেছিল, দীর্ঘমেয়াদে পাট রপ্তানির ওপর নির্ভরশীলতা রপ্তানি আয়কে সমস্যার মধ্যে ফেলবে। তাই রপ্তানিকারকদের নানা ধরনের প্রণোদনা দিয়ে রপ্তানি আয়ে বৈচিত্র্য আনা উচিত। যেহেতু চা ও কাগজ শুধু পশ্চিম পাকিস্তানেই রপ্তানি হতো, তাই এসব পণ্য রপ্তানির জন্য নতুন বাজার খোঁজা উচিত। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এতোটা দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশের রপ্তানি খাত এক পণ্য নির্ভর রয়েছে এখনও। তবে পাটের জায়গাটি দখল করেছে তৈরি পোশাক বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে খুব বেশি বৈচিত্র্য আনা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনত্রার আগে বাংলাদেশ মূলত পাট ও পাটজাত পণ্যের মতো প্রাথমিক পণ্য রপ্তানি করতো। এখন প্রস্তুতকৃত পণ্য বেশি রপ্তানি হয়। বর্তমানে রপ্তানি পণ্যের মোট ৯০ শতাংশই আসে উত্পাদন খাত থেকে, যা উন্নয়নশীল দেশে রীতিমত বিরল। তবে এক পণ্যের নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। ১৯৭০ দশকে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ছিল ৫০ থেকে ৭০ ডলার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, গত অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ১৪৬৫ ডলারে উন্নীত হয়েছে। আর বেকারত্ব হ্রাস পেয়ে এখন সাড়ে ৪ শতাংশে পৌঁছেছে। বর্তমান সরকারের নতুন শিল্পনীতিতে ৩২টি খাতকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে বাছাই করেছে। এই খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- পোশাক খাতের সংযোগশিল্প, জাহাজ নির্মাণ, ওষুধ ও ওষুধের উপাদান, তথ্যপ্রযুক্তি হালকা প্রকৌশল ও যানবাহন তৈরি, চামড়া ও পাদুকা, কৃষি ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং প্লাস্টিক। দেশের অর্থনীতি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বিনিয়োগ বাড়ানো। বিনিয়োগ বৃদ্ধি ছাড়া আমাদের অর্থনীতির সমৃদ্ধি আশা করা যায় না। ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য জিডিপির ৪ শতাংশের সমান বিনিয়োগ প্রয়োজন। ৮ থেকে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার। তবে বিনিয়োগ কম হলেও মানবসম্পদকে দক্ষ করে উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া এর বড় উদাহরণ। মানবসম্পদকে দক্ষ করতে এখন নানামুখী চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশের মতো এমন তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আর কোনো দেশে নেই। এ দেশের ৭৬ শতাংশ মানুষ কর্মক্ষম। এ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে হবে। আগামী ২০২৪ সাল নাগাদ বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে আসবে বলে আঙ্কটাডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার যে তিনটি সূচক আছে ২০২১ সালের মধ্যে এ তিনটি সূচকের একটিতেও পিছিয়ে থাকবে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশ বর্তমানে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এর পরের ধাপ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ। এলডিসি থেকে বের হলে বাংলাদেশের রপ্তানি কমতে পারে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন। তবে এলডিসি থেকে বের হলে অর্থনীতি নতুন উচ্চতায় পৌঁছে যাবে। তখন অনেক বিনিয়োগ আসবে। বিনিয়োগ বাড়লে রপ্তানি কমবে না, বরং বাড়বে। সব মিলিয়ে বদলে যাওয়া অর্থনৈতিক কাঠামো নিয়ে বাংলাদেশ আরো সমৃদ্ধি এবং অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাবে ক্রমেই-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।