বস্ত্র খাতে টেকসই উন্নয়ন ও সহায়তা প্রদান, বিনিয়োগ আকর্ষণ ও রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের তরফ থেকে রয়েছে নানামুখী উদ্যোগ। এরই ধারাবাহিকতায় এ শিল্পের আধুনিকায়ন, সমন্বয়, মান নিয়ন্ত্রণ ও দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্যে বস্ত্র আইন শীর্ষক একটি আইন করতে যাচ্ছে সরকার। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের কার্যাবলির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই আইনটি প্রণয়ন করা হচ্ছে। এ আইনের একটি ধারা অনুযায়ী, সংঘটিত অপরাধ অনামলযোগ্য বা অজামিনযোগ্য হিসেবে গণ্য হবে। তবে আইনের এ ধারার তীব্র বিরোধিতা করছেন বস্ত্র শিল্প খাতের মালিকরা।
জানা গেছে, আশির দশকে বাংলাদেশে পোশাক শিল্প বিস্তারের শুরু। এ শিল্পের সংযোগ শিল্প হিসেবে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে রফতানিমুখী বস্ত্র খাত। এছাড়া দেশে গড়ে উঠেছে হোমটেক্সটাইল ও টেরিটাওয়েল পণ্য উত্পাদনকারী বস্ত্র শিল্প। গত ৩০ বছরে এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিকাশে ছিল না সরকারি কোনো আইন। শিল্প নিয়ন্ত্রণে ছিল না কোনো নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ।
২০১২ ও ২০১৩ সালে তাজরীন ফ্যাশন ও রানা প্লাজা ভয়াবহতার পর সরকার বস্ত্র শিল্পের টেকসই উন্নয়নে মনোনিবেশ করেছে। সরকার পৃথক পোষক কর্তৃপক্ষ নিয়োগের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইছে। পাশাপাশি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এ খাতের টেকসই উন্নয়নে সহায়তা, বিনিয়োগ আকর্ষণ ও রফতানি বৃদ্ধি, বস্ত্র শিল্পের আধুনিকায়ন, সমন্বয় ও মান নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি মনে করছে সরকার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বস্ত্র আইন ২০১৬-এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বস্ত্র পরিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল বণিক বার্তাকে বলেন, আইনটির খসড়া প্রণয়নের ক্ষেত্রে মালিকদের মতামত শতভাগ আমলে নেয়া হয়েছে। আইনটি প্রক্রিয়াধীন। মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদন শেষে এটি চূড়ান্ত হবে। নিয়ন্ত্রণের চেয়ে সহায়তাই হবে এ আইনের মূল উদ্দেশ্য।
জানা গেছে, আইনে মোট ২২টি ধারা রয়েছে। এসব ধারার উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে— রাষ্ট্রায়ত্ত বস্ত্র কারখানাগুলোর ব্যবস্থাপনা ও তদারকি, বিনিয়োগ উন্নয়ন ও সহায়তা প্রদান, খাতের উন্নয়নে তহবিল গঠন, মান নিয়ন্ত্রণ, তদারকি ও সমন্বয়, খাতের শিল্প নিবন্ধন, দক্ষ জনবল তৈরি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন, গবেষণাকল্পে তথ্যভাণ্ডার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ, তথ্যাদি প্রদান ও মূল্য স্থিতিকরণ, অপরাধ ও দণ্ড, বিচার ও আপিল।
খসড়া আইনে অপরাধ ও দণ্ড ধারায় বস্ত্র আইনের আওতায় সংঘটিত অপরাধের ব্যাখ্যা রয়েছে। এ ধারা অনুযায়ী, আইনের অধীনে বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও নিবন্ধন গ্রহণ বা নিবন্ধন নবায়ন না করা হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে। আবার নিবন্ধন বাতিল বা স্থগিত হওয়ার পর আপিল ব্যতিরেকে বস্ত্র শিল্প বা কারখানার কার্যক্রম অব্যাহত রাখলেও তা অপরাধ হবে। সরকার বা পোষক কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তার পরিদর্শন কাজে বাধা প্রদান বা অসহযোগিতাও হবে অপরাধ। কেউ যদি নকল বা ডুপ্লিকেট নিবন্ধন বা এমন কোনো রেকর্ড রক্ষণাবেক্ষণ করেন, যা সঠিক নয় এবং তা যদি কর্মকর্তার পরিদর্শনকালে উপস্থাপন করেন, তবে তাও অপরাধ বলে গণ্য হবে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আইনের অধীনে প্রণীত বিধি লঙ্ঘন করলে বা প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে অনধিক দুই বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এছাড়া সংঘটিত অপরাধ যথাযথ মনে করলে আদালত সংশ্লিষ্ট পণ্য বা পণ্য প্রস্তুতের উপাদান ও সামগ্রী ইত্যাদি রাষ্ট্রের অনুকূলে সম্পূর্ণ বা আংশিক বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিতে পারবেন। আবার কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির মাধ্যমে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে বা অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা থাকলে মালিক, প্রধান নির্বাহী, ব্যবস্থাপক, সচিব বা অন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা প্রতিনিধি ওই অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবে।
অপরাধ, বিচার গ্রহণ ও বিচারের ব্যাখ্যায় খসড়া আইনে বলা হয়েছে, বস্ত্র পরিদপ্তর বা তদকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তার লিখিত অভিযোগ ছাড়া আইনের আওতায় সংঘটিত কোনো অপরাধকে কোনো আদালত আমলে বা বিচারের জন্য গ্রহণ করবেন না। ফৌজদারি কার্যবিধি বা অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, আলোচ্য আইনের অধীনে অপরাধসমূহ মোবাইল কোর্ট আইন অনুযায়ী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বিচার্য হবে অথবা ক্ষেত্রমতে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অথবা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বিচার্য হবে। একইভাবে অপরাধীদের উপরোক্ত আদালত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করতে পারবেন। এছাড়া আলোচ্য আইনের অধীনে অপরাধসমূহ অনামলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
এদিকে বিটিএমএ সদস্য মিল মালিকরা জানিয়েছেন, খসড়া বস্ত্র আইনে যেগুলোকে মালিকদের অপরাধ হিসেবে বলা হচ্ছে, সেগুলো ফৌজদারি অপরাধ নয়। তাই জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে এগুলোকে বিবেচনার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এছাড়া দেশে প্রচলিত অন্য আইন, যেমন শুল্ক আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু ধারা রয়েছে এতে। এসব বিষয় নিয়ে মন্ত্রণালয়ে আলোচনা হয়েছে।
বিটিএমএ ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, বস্ত্র আইন হচ্ছে, এখন তার ধারা ভঙ্গ হলে তা ফৌজদারি অপরাধ এটি অযৌক্তিক। আমরা আমাদের মত জানিয়েছি। খসড়ার সংশোধনীতে মালিকদের মত বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে— এমন আশাবাদ দেয়া হয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আইনের কঠোর বিষয়গুলো নিয়েই মালিকদের আপত্তি। আইন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে বড় শিল্প খাত হিসেবে কেন্দ্রীয় পোষক (স্পন্সর) সেবা দেয়া। কিন্তু সরকারি সংস্থার সক্ষমতা ও অন্যান্য খারাপ অভিজ্ঞতায় তারা কিছুটা আতঙ্কিত। তারা চাইছেন আইনের মাধ্যমে শুধু নিবন্ধন সেবা নিতে। মালিকদের মত বিবেচনায় নেয়া হলেও খাতের ভবিষ্যতের সুষ্ঠু বিস্তারে যতটা শক্তিশালী আইন প্রয়োজন, সরকার তাই করবে।