পণ্য রফতানিতে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা (জিএসপি) ভোগ করে আসছে। এ সুবিধা ভোগকারী দেশগুলোয় জিএসপির প্রভাবও নিয়মিত মূল্যায়ন করে ইইউ। সম্প্রতি ইইউ জিএসপির মধ্যবর্তী মূল্যায়ন কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এ মূল্যায়নের প্রাথমিক ফলাফলে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প পরিবেশে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে উল্লেখ করেছে ইইউ।
সামাজিক অধিকার, পরিবেশ ও মানবাধিকার বিষয়ক মূল্যায়নের ফলাফল বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি খাতসংশ্লিষ্টদের কাছে হস্তান্তর করেছে ইইউ। পরিবেশের ওপর প্রভাব বিষয়ে ইইউর মূল্যায়নে বলা হয়েছে, গার্মেন্টস পণ্য প্রস্তুত ও রফতানিতে বিশ্বের বৃহত্তম উত্স বাংলাদেশ। শিল্পটি বাংলাদেশের পরিবেশে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ শিল্প থেকে শুধু নারায়ণগঞ্জ শহরেই প্রতিদিন ১২০-১২৫ টন বর্জ্য তৈরি হয়। যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও কার্যকর নিয়মনীতির ঘাটতিতে এসব বর্জ্যে আশপাশের পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে।
পরিবেশ নিয়ে ইইউর মূল্যায়নে আরো বলা হয়েছে, গত দুই দশকে বাংলাদেশে জনপ্রতি কার্বন নিঃসরণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা ভীতিকর। এতে ক্ষতিকর সিসার উপস্থিতি জাতিসংঘের সুপারিশকৃত নিরাপদ মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। দ্রুত নগরায়ণ ও দুর্বল ব্যবস্থাপনায় শিল্পবর্জ্য ক্রমেই বড় সমস্যায় রূপ নিচ্ছে। ঢাকায় ৩৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ বর্জ্য সংগ্রহ করা হয় না। ফলে পরিবেশের মারাত্মক অবনতির পাশাপাশি তা স্বাস্থ্য সমস্যাকে প্রকট করে তুলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, পোশাক শিল্প শুরু হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। তবে এখন বড় পোশাক কারখানার বেশির ভাগেরই কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার আছে। এ অগ্রগতি পোশাক খাতের ব্যাকওয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড সব শিল্পেই আনতে হবে। ইইউর প্রাথমিক মূল্যায়নের কোনো নেতিবাচক প্রভাব জিএসপি সুবিধার ওপর পড়বে না বলেই আশা করছি।
ইইউর মূল্যায়নে বাংলাদেশের পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব রাখা শিল্পের মধ্যে চিংড়ি খাতের কথাও উঠে এসেছে। চিংড়ি চাষ বাংলাদেশের পরিবেশে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে উল্লেখ করে এতে বলা হয়েছে, এর প্রভাবে মাটির রাসায়নিক গঠনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এছাড়া পানির সুষ্ঠু প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করার পাশাপাশি পরিবর্তন আনছে এর মানেও।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এসএম আমজাদ হোসেন এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ইইউর মূল্যায়ন প্রসঙ্গে ড. আইনুন নিশাত বলেন, ইইউর বক্তব্যে এটা স্পষ্ট, তারা বাণিজ্যের উন্নয়ন চাচ্ছে টেকসই পদ্ধতিতে। পরিবেশের যে দূষণ হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যমান আইন অনুসরণ করলেই সেটা হওয়ার কথা নয়। মালিকরা দূষণ করছেন, কারণ ইটিপি পরিচালনায় তাদের খরচ বেড়ে যায়। অর্থাত্ মুনাফার জন্য ইটিপি ব্যবহার করছেন না মালিকরা। সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের বিষয়ে সরকার তত্পর। কিন্তু এতে উপকার হবে এক-তৃতীয়াংশ। এছাড়া বস্ত্র ও পোশাক শিল্পের বর্জ্য থেকে আসছে এক-তৃতীয়াংশ। আর বাকিটা আসছে ওয়াসার মাধ্যমে মানুষের বর্জ্য থেকে। বস্ত্র ও পোশাক খাতের; বিশেষ করে যেসব ডায়িং কারখানা পরিবেশসম্মতভাবে পণ্য উত্পাদন করছে না, তাদেরই বলা হচ্ছে তোমরা সাবধান হও।
তিনি আরো বলেন, যারা বাণিজ্য সুবিধা দিচ্ছেন, তারা যদি দেখেন যে, আমি যেখান থেকে পণ্য কিনছি, তারা পরিবেশসম্মতভাবে উত্পাদন করছে না, তাহলে এ প্রক্রিয়ায় সমর্থন পাওয়া যাবে না। আমাদের সব কারখানা খারাপ নয়। বিশ্বের সবচেয়ে ভালো ১০টির মধ্যে সাতটি কারখানাই বাংলাদেশে। এ পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটছে। প্রতিবেদনের বক্তব্য হলো, তোমরা যদি বাণিজ্য সুবিধা চাও, তাহলে দূষণ বন্ধ করতে হবে। চিংড়ির ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। কারণ যারা চিংড়ি রফতানি করে ডলার আয় করছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে তারা নিরাপদ থাকেন। কিন্তু যে অঞ্চলে চিংড়ি চাষ হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেখানকার সাধারণ মানুষ।
ইইউতে বাংলাদেশের রফতানি প্রসঙ্গে মূল্যায়নে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রফতানির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য হলো ইইউ। গত তিন দশকে বাংলাদেশের মোট রফতানির অর্ধেকেরও বেশি হয়েছে এ বাজারে। ২০১৫ সালে এর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫০০ কোটি ইউরো, যা ২০১৬ সালে বেড়ে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি ইউরোয় দাঁড়িয়েছে। ইবিএ (এভরিথিং বাট আর্মস) সুবিধার সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় পোশাক পণ্যে। ইইউভুক্ত দেশগুলোর পোশাক আমদানির ৯০ শতাংশই হয় বাংলাদেশ থেকে।
সামাজিক অধিকার প্রসঙ্গে ইইউর মূল্যায়ন বলছে, পোশাক খাতে ৪২ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে, যার ৫৫ শতাংশই নারী। এ কর্মসংস্থানের পরোক্ষ সুবিধাভোগীর সংখ্যা চার কোটি। সামাজিক পরিবর্তনেও এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর কিছুটা উন্নতি হলেও বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিস্থিতি সমস্যাগ্রস্ত। সংগঠিত হওয়ার পথে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি থাকলেও সংগঠিত হওয়ার অধিকার বাংলাদেশে এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হয়নি।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে ইইউ জিএসপি পদ্ধতি চালুর পর থেকে বাংলাদেশ এর সুবিধা ভোগ করে আসছে। এর আওতায় ২০০১ সালে অস্ত্র ব্যতীত (ইবিএ) বাংলাদেশের সব পণ্য ইইউতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পায়। ওই সময় থেকেই ইইউর বাজারে বাংলাদেশের পণ্য, বিশেষত তৈরি পোশাক রফতানি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বর্তমানে ইবিএর আওতায় ইইউতে আমদানিকৃত পণ্যের ৬৯ দশমিক ১ শতাংশই বাংলাদেশের।