দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনা আছে। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের ধাক্কা কাটিয়ে উন্নয়নের পথে রয়েছে দেশটি।
ইউরোপ ও আমেরিকার আদলে পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া চলছে দ্রুতগতিতে। দেশটি প্রতি বছর কয়েক বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করছে বিভিন্ন দেশ থেকে। ওষুধ, পাট, চা ও চামড়ার মতো বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রপ্তানি পণ্যেরও ব্যাপক চাহিদা দেশটিতে। কিন্তু প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে সে সুযোগ এত দিন কাজে লাগাতে পারেনি বাংলাদেশ। অথচ কম্বোডিয়াকে গণহত্যার বিভীষিকাময় পরিবেশ থেকে বের করে আনতে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। কম্বোডিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত প্রবাসী বাংলাদেশিরা বলছেন, কিছুটা বিলম্ব হলেও এখনো হাতছানি দিচ্ছে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। বাণিজ্য-বিনিয়োগ সম্মেলনের মাধ্যমে গত সপ্তাহে যে উদ্যোগের সূচনা হয়েছে, এখন শুধু তা এগিয়ে নিলেই লাভবান হবে বাংলাদেশ। সদ্য কম্বোডিয়া ঘুরে আসা ঢাকার ব্যবসায়ী নেতৃত্ব, করপোরেট প্রতিনিধি ও কূটনীতিকরা বলছেন, সবার আগে প্রয়োজন ঢাকা-নমপেনের রাজনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি। দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের সমঝোতা নিমেষেই দূর করতে পারে বাণিজ্য-বিনিয়োগের বিদ্যমান বাধা। তাই উভয় দেশে একে অন্যের দূতাবাস বা মিশন স্থাপনে মনোযোগী হওয়ায়ই হতে পারে প্রথম পদক্ষেপ। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন ও পুরনো রাজধানী সিয়াম রিপে একের পর এক গড়ে উঠেছে আকাশচুম্বী অত্যাধুনিক ভবন ও শপিং মল। দেশজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ইউরোপ ও আমেরিকার পর্যটকরা। কয়েক বছর আগেই বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পর্যটকের গন্তব্যস্থল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে দেশটি। অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনের সব বিনিময়ই হচ্ছে মার্কিন ডলারে। বিশ্বের নামকরা সব ব্র্যান্ড তাদের শোরুম, হোটেল ও ক্যাসিনো নিয়ে হাজির হয়েছে কম্বোডিয়ায়। সিঙ্গাপুরের বিলাসী ‘মেরিনার বে’র অনুরূপ দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো আগের চেয়ে বড় পরিসরে তৈরি হচ্ছে কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে। নাগা-ওয়ানের মতো বিশ্বব্যাপী পরিচিত বিলাসী ব্র্যান্ডগুলোরও ছড়াছড়ি এখন কম্বোডিয়ায়। জনজীবনও উন্নত হচ্ছে প্রতিদিনই। ঘরে ঘরে স্থান করে নিয়েছে লেক্সাসের মতো দামি গাড়ি। পাশাপাশি দেশটির জিডিপিও ৭-এর ওপরে। প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশকেও ছাড়িয়েছে দেশটি। অর্থনীতির ভবিষ্যদ্বক্তারা বলছেন, বাংলাদেশের আগেই উন্নত দেশের তালিকায় নিজেদের নিয়ে যাবে কম্বোডিয়া। আর উন্নয়ন মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন তো চলছেই। জানা গেল, খেমাররুজদের এই দেশে মাত্র কয়েক ডজন বাংলাদেশি বর্তমানে বসবাস করছেন। এর মধ্যে প্রথম বাংলাদেশি এম এইচ কবির ‘বাংলাদেশ ট্রেডিং কোম্পানি’ নামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন প্রায় ২৫ বছর। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি মূলত ওষুধ মার্কেটিংয়ের ব্যবসা করছি। কোম্পানির নাম বাংলাদেশ হলেও বিক্রি করতে হচ্ছে ভারতীয় ওষুধ। বাংলাদেশি ওষুধ বিশ্বব্যাপী নানান স্বীকৃতি অর্জন করলেও, কম্বোডিয়ার জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি এখনো। সাধারণ কম্বোডিয়ানের বেশির ভাগের কাছে বাংলাদেশের নামই অজানা। এ ছাড়া মূল্যের ক্ষেত্রেও ভারতীয় ওষুধ ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক। তাই আমদানিকারকদেরও প্রথম পছন্দ ভারতীয় ওষুধ। ’ এম এইচ কবির বলেন, কম্বোডিয়ার ওষুধ বাজারের ৬০ শতাংশ ভারতের দখলে। আর্থিক হিসেবে এর পরিমাণ কমপক্ষে ৫০ মিলিয়ন। প্রতি বছরই এই বিশাল অঙ্কের অর্থ ভারতে যাচ্ছে শুধু কম্বোডিয়ার ওষুধের মার্কেট থেকে। কিন্তু ভারতের তুলনায় ভালো ওষুধ তৈরি করেও বাংলাদেশ কম্বোডিয়ায় ৪ শতাংশের কম বাজার ধরতে সক্ষম হয়েছে। তাও অনেক সময় কমে যায়। আসলে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে বাংলাদেশ এ বাজার হাতছাড়া করে আসছিল। এখন বাণিজ্য বৃদ্ধিও যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা সফল হলে বাংলাদেশ এখানকার ওষুধ মার্কেটে সহজেই লিড নিতে পারবে বলে মনে করেন তিনি। গার্মেন্টস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশি খায়ের মিয়া বলেন, কম্বোডিয়া মূলত পর্যটনে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী। বিশ্বের ধনী পর্যটকরা এ দেশে আসেন। তারা পাটজাত বিভিন্ন স্যুভেনির সংগ্রহে আগ্রহী। এ সুযোগ সহজেই কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, এটা শুধু একটা উদাহরণ। বাংলাদেশের রড থেকে চামড়া পর্যন্ত ১০-১২টি খাতে বড় অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে কম্বোডিয়ায়। সেভ দ্য চিলড্রেনের কর্মকর্তা হিসেবে কম্বোডিয়ায় অবস্থান করা বাংলাদেশি আকতারুজ্জামান সানু বলেন, কম্বোডিয়ায় একবার বাংলাদেশের ইতিবাচক ইমেজ তুলে ধরতে পারলেই সব বাণিজ্যিক সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাবে। তবে এম এইচ কবির, খায়ের মিয়া ও আকতারুজামান সানু সবাই একবাক্যে বললেন, দুই দেশের মধ্যে থাকা ভিসা সমস্যার সমাধান ছাড়া সুযোগ কাজে লাগানো সম্ভব নয়।
দূতাবাস স্থাপন ছাড়া এ ভিসা সমস্যার সমাধানও দেখছেন না এই প্রবাসীরা। তবে তারা তিনজনই গত সপ্তাহে কম্বোডিয়ায় হওয়া বাংলাদেশ ট্রেড কনফারেন্সের কারণে উচ্ছ্বসিত। তারা বলছেন, থাইল্যান্ডে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাস কম্বোডিয়ায় এসে যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা ঐতিহাসিক। এখন কম্বোডিয়ার মিনিস্ট্রি লেভেলে আলোচনা বা বৈঠক হতে পারে দ্বিতীয় পদক্ষেপ। আর বাংলাদেশের শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা যেমন কম্বোডিয়া সফর করে গেছেন তেমনি কম্বোডিয়ার ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদেরও ঢাকায় সফরে নিয়ে যেতে হবে।
কম্বোডিয়া-বাংলাদেশ বাণিজ্য-বিনিয়োগ বৃদ্ধিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সাঈদা মুনা তাসনীম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কম্বোডিয়ায় আবাসিক দূতাবাস না থাকায় থাইল্যান্ড থেকে এখানে কাজ করতে হচ্ছে। এর পরও দূতাবাস আশাবাদী। কম্বোডিয়া সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে। কম্বোডিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে নমপেনে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের চেম্বার স্থাপনের ইতিবাচক সম্মতি আদায় সম্ভব হবে। শিগগির এই চেম্বারের আনুষ্ঠানিক সূচনার জন্য দূতাবাস কাজ করছে জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এখনই দূতাবাস স্থাপন সম্ভব না হলেও অন্তত অনারারি কনসাল জেনারেল নিয়োগ সম্ভব হবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। ’ এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কম্বোডিয়ার সাবেক রাজার বন্ধুত্ব কাজে লাগিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের নতুন সূচনা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কম্বোডিয়ায় দ্বিপক্ষীয় সফরের বিষয়ে দূতাবাস কাজ করছে’ বলেও জানান এই রাষ্ট্রদূত।