সার্বিক নিরাপত্তা, পরিষেবা ব্যবহারে ব্যর্থতা রয়েছে। শ্রমের নিম্নমজুরির ওপর ভর করে হ্রাসমান পণ্যমূল্যের বাজারে প্রতিযোগিতায় বড় হওয়ার সাফল্যও আছে। প্রাকৃতিক গ্যাস ও আমদানিকৃত তেলের দ্বিতীয় বৃহত্ ব্যবহারকারী বস্ত্র ও পোশাক খাত। কিন্তু জ্বালানির অদক্ষ ব্যবহারে শীর্ষে রয়েছে এ খাত। অদক্ষ ব্যবহারের কারণে মোট জ্বালানি অপচয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই হয় বস্ত্র ও পোশাক শিল্পে। এতে একদিকে জ্বালানির ওপর চাপ বাড়ছে, অন্যদিকে পণ্য উত্পাদন ব্যয় বেশি হচ্ছে।
বস্ত্র ও পোশাক শিল্পে জ্বালানি অপচয়ের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে বিদ্যুত্ খাতের মহাপরিকল্পনা ২০১৫-এর খসড়ায়। এতে বলা হয়েছে, বর্তমানে মোট জ্বালানির ৩০ শতাংশ ব্যবহার হয় বস্ত্র ও পোশাক খাতে। এ খাতের কারখানায় আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন ও দক্ষতার সঙ্গে তা পরিচালনা করা গেলে জ্বালানির ব্যবহার ১৭ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসবে। এ হিসাবে বস্ত্র ও পোশাক শিল্পে ব্যবহূত জ্বালানির ১২ দশমিক ৪ শতাংশ অপচয় হচ্ছে।
শিল্প খাতে জ্বালানি দক্ষতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা ড. ম তামিম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বস্ত্র ও পোশাক খাতসহ শিল্প খাতে জ্বালানি অপচয় হয় দুভাবে। এর একটি হচ্ছে অদক্ষ বয়লার। সাধারণত বয়লারের উত্পাদন সক্ষমতা হওয়া উচিত ৯০ শতাংশ। কিন্তু আমাদের অধিকাংশ কারখানায় এর সক্ষমতা ৬০-৬৫ শতাংশ। এছাড়া জেনারেটরের উত্পাদন সক্ষমতা হওয়ার কথা ৪৫ শতাংশ। পুরনো হওয়ার কারণে আমাদের এখানে তা ৩৫ শতাংশেরও কম। এক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করা গেলে বস্ত্র ও পোশাক খাত থেকে এখনো ২০ শতাংশ জ্বালানি সাশ্রয় সম্ভব।
বস্ত্র ও পোশাক খাতের বিভিন্ন কারখানায় খোঁজ নিয়েও বেশি মাত্রায় জ্বালানি অপচয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। গাজীপুরে বস্ত্র খাতের একটি প্রতিষ্ঠান ১৫ বছরের বেশি পুরনো মেশিন দিয়ে সুতা উত্পাদন করছে। পুরনো মেশিনের কারণে কারখানাটিতে ১৫ শতাংশ বেশি গ্যাস ও বিদ্যুত্ ব্যবহার হয়। একইভাবে ময়মনসিংহের ভালুকায় বস্ত্র খাতের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের বয়লার পুরনো হওয়ায় ব্যবহূত গ্যাসের ২০ শতাংশের বেশি অপচয় হচ্ছে।
জানতে চাইলে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শুধু পোশাক খাত বিবেচনা করলে এখানে জ্বালানির ব্যবহার খুবই কম। কম্পোজিট শিল্প ইউনিটগুলোয় বস্ত্র ও পোশাক দুই ধরনের কারখানাই থাকে। তবে কম্পোজিট ইউনিটগুলো অনেক কমপ্লায়েন্ট। তাই পানি, বিদ্যুত্-জ্বালানির মতো পরিষেবার ব্যবহারও হয় খুব দক্ষতার সঙ্গে।
প্রায় একই দাবি করেন বস্ত্র খাতের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সাবেক সহসভাপতি ফজলুল হকও। তিনি বলেন, বস্ত্র খাতই একমাত্র শিল্প, যেখানে সরবরাহকৃত জ্বালানির ৭০ শতাংশের বেশি ব্যবহার হয়। বিশেষ করে ক্যাপটিভে (নিজস্ব বিদ্যুেকন্দ্র) পরিচালিত কারখানায় দক্ষতা ৮০-৮৫ শতাংশ। কিছু ক্ষেত্রে পুরনো জেনারেটর ব্যবহার হয়। এতে গ্যাসের ব্যবহারও বেড়ে যায়। তবে এসব জেনারেটর পরিবর্তনে মালিকরা আগ্রহী। সরকারের সহযোগিতায় এ ধরনের রূপান্তর সম্ভব। সার্বিকভাবে বলা যায়, বস্ত্র ও পোশাক শিল্পে যতটা দক্ষভাবে জ্বালানি ব্যবহার হয়, অন্য কোনো খাতে হয় না।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জ্বালানি অপচয় হয় আবাসিকসহ অন্যান্য খাতে। এ খাতে বর্তমানে মোট জ্বালানির ৪৫ দশমিক ২ শতাংশ ব্যবহার হয়। কিন্তু দক্ষ জ্বালানি যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে তা ১০ দশমিক ৪ শতাংশ সাশ্রয় করে ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব।
এছাড়া বাণিজ্যিক সার কারখানা তথা ইউরিয়া কারখানায় বর্তমানে মোট জ্বালানির ১৩ দশমিক ২ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে। এসব কারখানায় যদি দক্ষ জ্বালানিনির্ভর যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপন করা হয়, এখান থেকেও ৪ দশমিক ৮ শতাংশ জ্বালানি সাশ্রয় করা সম্ভব। এর বাইরে দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে স্টিল ও রি-রোলিং মিল থেকে ১ দশমিক ৯ শতাংশ, সিমেন্ট কারখানা থেকে দশমিক ৯ এবং হিমাগার ও কেমিক্যাল খাত থেকে দশমিক ৬ শতাংশ জ্বালানি সাশ্রয় করা সম্ভব।
জ্বালানি অপচয়ের একই চিত্র উঠে এসেছে ২০১৫ সালে পরিচালিত পেট্রোবাংলার এক সমীক্ষায়ও। সমীক্ষায় দেখা যায়, বয়লার আছে এমন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন প্রায় ৩৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন হয়। দক্ষতার উন্নয়ন ঘটানো গেলে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে দৈনিক ১৭ শতাংশ গ্যাস সাশ্রয় করা সম্ভব। অর্থাত্ বয়লার আছে এমন শিল্পকারখানা থেকে দিনে ৫ দশমিক ৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস বাঁচানো সম্ভব।
এছাড়া সারা দেশের ক্যাপটিভ পাওয়ার থেকে দৈনিক ৫০ শতাংশ তথা ২২ দশমিক ৪ কোটি ঘনফুট এবং রি-হিটিং ফার্নেস কারখানা থেকে দৈনিক ১৮ শতাংশ গ্যাস সাশ্রয় সম্ভব।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩২০ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে সরবরাহ হচ্ছে ২৭০ কোটি ঘনফুট। ফলে ঘাটতি থাকছে ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের। তবে সব খাতে গ্যাসের অপচয় বন্ধ করা গেলে ৮৩ কোটি ঘনফুট সাশ্রয় সম্ভব।
এছাড়া দক্ষ যন্ত্রাংশ ব্যবহারের মাধ্যমে জ্বালানি তেলের ব্যবহারও কমিয়ে আনার সুযোগ রয়েছে। এতে জ্বালানি তেল আমদানির পরিমাণ কমে আসবে। ফলে আমদানি ব্যয়ও কমবে।