চার বছর ধরে পোশাকশিল্পে কর্মসংস্থান স্থবির হয়ে আছে। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কর্মসংস্থান ৪০ লাখে থেমে আছে। অথচ এর আগের ৯-১০ বছরে এই খাতে কর্মসংস্থান দ্রুত হয়েছে। এতে পোশাক রপ্তানি আয় বেড়েছে। গতকাল সোমবার কর্মসংস্থান ও উন্নয়ন নিয়ে আয়োজিত এক প্রাক্-বাজেট আলোচনায় মূল প্রবন্ধে এ কথা বলা হয়েছে। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আয়োজক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চের (সিডিইআর) এক্সিকিউটিভ চেয়ারপারসন রুশিদান ইসলাম রহমান।
রুশিদান ইসলাম রহমান মনে করেন, দুটি কারণে পোশাকশিল্পে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। প্রথমত, প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় শ্রমনির্ভরতা কমেছে। দ্বিতীয়ত, সার্বিক মান (কমপ্লায়েন্স) নিশ্চিত করতে না পেরে অনেক ছোট কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, এটি নিয়ে এখন চিন্তিত হওয়ার সময় এসেছে। আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) মিলনায়তনে আয়োজিত এই আলোচনায় বিশেষ অতিথি ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
রুশিদান ইসলাম রহমান তাঁর মূল প্রবন্ধে বলেন, চার বছর আগেও বাজেটে কর্মসংস্থান কীভাবে বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে কিছু বক্তব্য এবং অর্থবছরে কর্মসংস্থানের একটি লক্ষ্য দেওয়া হতো। কয়েক বছর ধরে সেটা করা হচ্ছে না। আমার মতে, এটি শুধু করতেই হবে তা নয়; বিস্তারিতভাবে করতে হবে। বাজেটের মধ্যে একটি কর্মসংস্থান বাজেট থাকা প্রয়োজন। এই গবেষকের মতে, শুধু তৈরি পোশাক খাতের ওপর ভিত্তি করে কর্মসংস্থান কত দূর এগোবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য এনে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা উচিত। তাঁর মতে, নারীদের শ্রমবাজারে প্রবেশের সুযোগ বাড়াতে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। আবার তরুণ শ্রমশক্তির চাকরির সুযোগ বাড়াতে উপজেলা পর্যায়ে তথ্যকেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করেন তিনি।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ তাঁর বক্তব্যে বলেন, বাজেট ঘোষণার পর শুধু প্রস্তাবিত বাজেট নিয়েই বেশি আলোচনা হয়। কিন্তু যে বাজেট বাস্তবায়িত হচ্ছে, তা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না। অথচ যে বাজেট বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তা বিশ্লেষণ করা উচিত। প্রকল্প কতটা বাস্তবায়িত হলো, এর ওপরই কর্মসংস্থানের বিষয়টি জড়িত। আবার বাজেটের ব্যয় দিয়ে বিনিয়োগ পরিবেশের চিত্র পাওয়া যায়। বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসা করার (ডুয়িং বিজনেস) সূচকের সমালোচনা করে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদনের সূচকগুলো শুধু বড় শিল্পের জন্য প্রযোজ্য। যেমন লাইসেন্স, বিদ্যুৎ প্রাপ্তি ইত্যাদি। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক খাতগুলো মাপার সুযোগ নেই। তাই দেশের উপযোগী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য সূচক তৈরি করা উচিত।
নতুন মূসক আইন সম্পর্কে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, এটা অনেকটা ভোক্তা করের মতো হয়ে যাচ্ছে; মূসকদাতার জন্য কোনো প্রণোদনা নেই। মূসক আইন বাস্তবায়নের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সক্ষমতাও বিবেচনা করা উচিত। আলোচনা সভায় কর্মসংস্থান নিয়ে আরও চারটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিডিইআরের জ্যেষ্ঠ গবেষক কাজী শাহাবুদ্দীন, জ্যেষ্ঠ গবেষক এ টি এম নুরুল আমিন, ভিজিটিং ফেলো রিজওয়ানুল ইসলাম ও কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (সিএবি) সভাপতি গোলাম রহমান। এসব প্রবন্ধের ওপর বিশেষ আলোচক, বিআইডিএসের মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ বলেন, ‘কারিগরি শিক্ষাকে আমরা একঘরে করে রেখেছি। কারিগরি বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাই হীনম্মন্যতায় ভোগে। কর্মসংস্থানের স্বার্থে এই কারিগরি শিক্ষাকে মূলধারায় আনতে হবে।’ তাঁর মতে, উচ্চমূল্যের পণ্য উৎপাদন করতে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন করতেই হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন কর্মসংস্থান একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। আবার একটি প্রতিষ্ঠান খরচ কমানোর জন্য পণ্য ও সেবা আউট সোর্সিং করে থাকে। ওই পণ্য ও সেবা যিনি সৃষ্টি করছেন, তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না। এমনকি জানেন না যে কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য তিনি পণ্য তৈরি করছেন। আরেক আলোচক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এ দেশে তিন-চার বছর পর পর কর্মসংস্থানের তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়। এটা মাসিক, ত্রৈমাসিক কিংবা বার্ষিক ভিত্তিতে হওয়া উচিত। তাঁর মতে, কর্মসংস্থানের জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
এ টি এম নুরুল আমিন তাঁর প্রবন্ধে দেশের কর্মসংস্থান পরিস্থিতি তুলে ধরেন। সেখানে বলা হয়, বর্তমানে কর্মরত মোট জনগোষ্ঠী ৫ কোটি ৮০ লাখ। এর মধ্যে হকার, ফেরিওয়ালা, গৃহকর্মী, গাড়িচালক ও সহযোগী, নির্মাণশ্রমিকের মতো অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মস্থান হলো ৫ কোটি ৭ লাখ। আর আনুষ্ঠানিক খাতে ৭৩ লাখ মানুষ কাজ করেন।