ডোনাল্ড ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নীতি উদ্বেগ ছড়াচ্ছে দেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের মধ্যে। পণ্য প্রবেশে শুল্কারোপের ঘোষণায় শঙ্কিত রপ্তানিকারকরা। এ ছাড়া ভারতের পোশাক খাতের উন্নয়নে বিশাল অঙ্কের প্রণোদনা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে যাওয়া, চীনের বাজার কমমূল্যে পণ্য বাজারজাতকরণের উদ্যোগে শঙ্কিত দেশের পোশাক মালিকরা। এ অবস্থায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন তারা। তাদের মতে, বিশ্ব অর্থনীতির বেড়াজালে পড়েছে দেশের পোশাক খাত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) বাতিলে বাংলাদেশ কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য প্রবেশে ১০ শতাংশ শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিকারক দেশগুলোয় উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। যার বাইরে নয় বাংলাদেশ। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ চীন। এ আমদানি পণ্যের ওপর শুল্কারোপ বাড়ানোয় চীনের রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কায় পণ্যের দাম আরও কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। যার প্রভাব পড়বে দেশের পোশাক রপ্তানিতে। তারা আরও বলেন, বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানিবাজার যুক্তরাজ্য। গত বছর ব্রেক্সিটের তাপে পাউন্ডের দরপতন ছিল টানা কয়েক মাস। এই সময় নতুন করে অর্ডার নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন ক্রেতারা। একই সঙ্গে পুরনো অর্ডার নেওয়ার ক্ষেত্রেও কিছুটা সময় চেয়ে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন সেখানকার ক্রেতারা। ভবিষ্যতে ব্রেক্সিটের কার্যক্রম পুরোপুরি চালু হলে পোশাক খাতের ওপর আবার ধাক্কা আসবে বলে মনে করছেন তারা।
পোশাক মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাসির এ বিষয়ে বলেন, গত কয়েক মাস ধরে দেশের পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি কমছে। তার পেছনের কারণ হচ্ছে বিশ্বে পোশাকের বাজার ছোট হয়ে আসছে। মানুষের অর্থনীতির সংগতি কমছে। যার কারণে অর্ডার কমে যাচ্ছে। তা ছাড়া ভবিষ্যতে অর্থনীতির জন্য যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র নতুন নীতিমালা করছে। এর প্রভাব হয়তো পড়বে দেশের পোশাক খাতের ওপর। তা ছাড়া প্রতিনিয়ত যেভাবে পোশাকের দাম কমছে তাতে উৎপাদন খরচের সঙ্গে সমন্বয় করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
বিজিএমইএর দেওয়া তথ্যমতে, ধারাবাহিকভাবে কমছে পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে নিট পোশাকে প্রবৃদ্ধি কমেছে ২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর ওভেন খাতে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি কমেছে ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ। একই সঙ্গে গত বছরের মার্চের তুলনায় কমেছে ৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
বিজিএমইএর হিসাবে, ইউরোপের বাজারে রপ্তানি বেড়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। তবে অন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বাজার যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি কমেছে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ। একই সঙ্গে কানাডার বাজারে পোশাক রপ্তানি কমেছে ৭ দশমিক ১০ শতাংশ।
বিজিএমইএর দেওয়া তথ্যমতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮টি দেশে ২০১৬ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পোশাকের দাম কমেছে ২ দশমিক ৮৫ শতাংশ। একইভাবে ২০১৬ সালের জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অন্যতম বড় রপ্তানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকের দাম কমেছে ০.৫৩ শতাংশ। একদিকে রপ্তানির মূল্যহ্রাস অন্যদিকে উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধি এবং টাকার শক্তিশালী অবস্থানের কারণে মোট আয়ের পরিমাণ কমেছে ৬২ দশমিক ৮৪ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১৩ সালে যে কোনো এক পিস পোশাক রপ্তানি করে নিট আয় হতো ১২ টাকা। সেখানে ২০১৫ সালে নিট আয় হচ্ছে ৪ টাকা। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমলেও ২০১৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত পোশাকের উৎপাদন খরচ বেড়েছে প্রায় ১৭ দশমিক ১১ শতাংশ।
বিজিএমইএর সহ-সভাপতি ফেরদৌস পারভেজ বিভান বলেন, ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে একটু টানাপড়েন চলছে। যার ধারাবাহিকতায় পোশাক রপ্তানি কমছে। তা ছাড়া আগে ক্রেতারা সাব-কন্টাক্ট করতেন। এখন তারা সরাসরি কারখানা থেকে পণ্য কিনছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো বাংলাদেশকে পিছিয়ে রাখতে তাদের পোশাক খাতে হরেকরকম সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। নতুন নতুন বাজার তৈরিতে উদ্যোগ নিচ্ছে।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী জানান, রানাপ্লাজা ধস পোশাকশিল্পের জন্য একটা বড় ধাক্কা। তবে দেশের শিল্পোদ্যোক্তাদের দৃঢ় মনোবলের কারণে এ শিল্প টিকে আছে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার পোশাকশিল্পের জিএসপি স্থগিত হওয়ায় আরেকটি ইমেজ সংকট দেখা দেয়। তবে এত কিছুর পরও পোশাক রপ্তানি আশানুরূপ বাড়ছে না। কোনো এক জায়গায় গিয়ে থেমে আছে। তার পেছনের কারণ বিশ্ব অর্থনীতির টানাপড়েন। প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে সিদ্ধান্তের। তা ছাড়া প্রতিন্দ্বন্দ্বী দেশগুলোও নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করছে। তাই প্রবৃদ্ধি যেভাবে কমছে তাতে ২০২১ সালে রপ্তানি আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়বে।