যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোর জেসিপেনি। পোশাক, নিত্যপ্রয়োজনীয়, ভোগ্যসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির পোশাকপণ্য সরবরাহের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যায় বাংলাদেশ থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৯টি অঙ্গরাজ্যে এক হাজারেরও বেশি বিক্রয়কেন্দ্র থেকে এসব পণ্য বিক্রি হয়ে থাকে। কিন্তু গত মাসে প্রায় ১৪০টি বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধের ঘোষণা দেয় প্রতিষ্ঠানটি। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সিয়ার্স হোল্ডিংস ও কেমার্টও বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে সম্প্রতি। স্বনামধন্য এসব ব্র্যান্ডের ব্যবসা সংকোচনের এ ঘোষণায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি দেয়া ঘোষণায় জেসিপেনি জানায়, সফলভাবে মুনাফায় ফিরতে জেসিপেনির জাতীয় রিটেইল অপারেশনের অনুকূল পরিবেশ ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী কয়েক মাসে প্রায় ১৪০টি স্টোর বন্ধ করা হবে। জেসিপেনির এ ঘোষণা বাস্তবায়ন শুরু হবে আগামী মাস থেকে। এ ঘোষণা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করলে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ছয় হাজার কর্মী সংকটে পড়বেন। একই সঙ্গে বিক্রয় চেইন ছোট হয়ে আসার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারকদের ওপর।
জানা গেছে, বাংলাদেশের ৩০-৩৫টি কারখানা জেসিপেনির জন্য পোশাক তৈরি ও রফতানি করে। এর মধ্যে বড় অংকের ক্রয়াদেশ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হা-মীম, ওপেক্স, এপিক গার্মেন্টস, ইস্টার্ন গ্রুপ, এমবিএম গার্মেন্টসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে। জেসিপেনি প্রতি বছর ১০-১৫ কোটি ডলারের পোশাক বাংলাদেশের কারখানাগুলো থেকে কেনে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয়কেন্দ্র কমিয়ে আনার সিদ্ধান্তের বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট পোশাক কারখানা মালিকরা। এ প্রসঙ্গে জেসিপেনি ঢাকা কার্যালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
দেশের অন্যতম বড় পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠান হা-মীম গ্রুপ বছরে প্রায় ২ কোটি ডলারের পোশাক পণ্য জেসিপেনিকে সরবরাহ করে থাকে। ব্র্যান্ডটির ব্যবসা সংকোচনের প্রভাব এখনো এ প্রতিষ্ঠানের ওপর পড়েনি বলে জানান হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, জেসিপেনির এ সিদ্ধান্তের প্রভাব সরাসরিভাবে এখনো আমরা প্রত্যক্ষ করিনি। তবে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে এ সিদ্ধান্তের প্রভাব নিঃসন্দেহে পড়বে। এরই মধ্যে তুলনামূলক ছোট প্রতিষ্ঠানের ক্রয়াদেশ কমে গিয়ে থাকতে পারে। তবে আমাদের প্রতিষ্ঠানে জেসিপেনির ক্রয়াদেশ আগের তুলনায় বেড়েছে।
শিল্প-সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বাংলাদেশ থেকে সরবরাহকারী কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে জেসিপেনির, যা প্রায় এক বছর আগে থেকেই বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে তুলনামূলক ছোট প্রতিষ্ঠানে ক্রয়াদেশ দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি বেড়েছে বড় সরবরাহকারীর বিপরীতে ক্রয়াদেশের পরিমাণ। এরই ধারাবাহিকতায় বড় কারখানাগুলোয় বছরে ১০ শতাংশ হারে ক্রয়াদেশ বাড়িয়েছে জেসিপেনি। হা-মীম গ্রুপ গত মৌসুমে ১ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পোশাক তৈরির ক্রয়াদেশ পেলেও চলতি মৌসুমে তা বেড়ে ২ কোটি ৩০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে বলে জানা গেছে।
একইভাবে বেড়েছে চট্টগ্রামের ইস্টার্ন গ্রুপের বিপরীতে জেসিপেনির ক্রয়াদেশের পরিমাণও। জেসিপেনিকে বছরে গড়ে প্রায় ১ কোটি ডলারের পোশাকপণ্য সরবরাহ করে গ্রুপটি। স্টোর বন্ধের প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে ইস্টার্ন গ্রুপের প্রতিনিধিরা জানান, এখনো সরাসরি কোনো প্রভাব দেখা যায়নি। চলতি মৌসুমে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ক্রয়াদেশ দিয়েছে মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি।
ইস্টার্ন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির উদ্দিন চৌধুরি বলেন, জেসিপেনির এ সিদ্ধান্তের প্রভাব পরবর্তী সময়ে পড়বে বলে আশঙ্কা রয়েছে। জেসিপেনি অনেক বড় প্রতিষ্ঠান, তাদের স্টোরও অনেক। তাই দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা সম্পর্কে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।
পোশাক শিল্প মালিকরা জানান, জেসিপেনির মতো বড় ক্রেতারা ব্যবসা সংকোচন শুরু করলে এর প্রভাব পোশাকের বড় সরবরাহকারী হিসেবে বাংলাদেশের রফতানিকারকদের ওপর পড়বে, যা এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। জেসিপেনি আগে যে কারখানায় ২০ লাখ ডলারের ক্রয়াদেশ দিত, তা এখন বাড়িয়ে ৩০ লাখ ডলার করছে। এ বাড়তি ১০ লাখ ডলারের কাজ আগে তুলনামূলক ছোট কারখানাগুলোকে দেয়া হতো। ফলে ব্যবসা সংকোচন ও সরবরাহকারী কমিয়ে আনার এ পরিকল্পনায় সংকটে পড়ছে মূলত ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো।
অর্থনৈতিক মন্দার মুখে জেসিপেনির মতোই বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধের ঘোষণা দিচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। জেসিপেনির মতো সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সিয়ার্স হোল্ডিংস বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধের ঘোষণা দেয়। প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব ব্র্যান্ডের ২৬টি বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠানটি ১৬টি বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিল। এছাড়া গত ডিসেম্বরে ৩০টির পর সম্প্রতি আরো ৭৮টি বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে কেমার্ট। এছাড়া মেসি’স, অ্যাবারকম্বি অ্যান্ড ফিচ, দ্য লিমিটেড, ওয়েট সিল, অ্যামেরিকান অ্যাপারেলও বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে।
জেসিপেনি ও সিয়ার্স হোল্ডিংসের জন্য বাংলাদেশের একেএইচ গ্রুপ পোশাক সরবরাহ করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম বলেন, আমরা জেসিপেনির কাজ আগে করতাম। এখন করছি না। জেসিপেনির মতো অনেক ক্রেতাই আছেন, যারা রিটেইল স্টোর বন্ধ করছেন। সাম্প্রতিককালে এমন আরেকটি প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের সিয়ার্স হোল্ডিংস। এ প্রতিষ্ঠানও তাদের বেশকিছু বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ করেছে। এটা বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকারকদের জন্য অশনিসংকেত। কারণ এটি ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা কমার ইঙ্গিত। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ দুই বাজারেই মন্দা বিরাজ করছে। আবার মুদ্রার অবমূল্যায়নও এরপর হয়েছে। কিন্তু এসব পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমরা জাতীয় নীতি প্রণয়ন করতে পারিনি। সব মিলিয়ে আগামী দিনগুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন আমরা।
বড় ব্র্যান্ডগুলোর ব্যবসা সংকোচন কিংবা শিল্প দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরবরাহকারীর সংখ্যা কমিয়ে আনায় সব দিক থেকেই মূলত সংকটে রয়েছে ছোট কারখানাগুলো। পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠনের তথ্যমতে, প্রায় সব বড় ক্রেতাই বাংলাদেশ থেকে পোশাক ক্রয়ে সচেতন অবস্থান নিচ্ছে। কমপ্লায়েন্স ব্যবস্থাপনায় সতর্কতার কারণে অধিকাংশ ক্রেতাই বড় সরবরাহকারীর ওপরই আস্থা রাখছে। তুলনামূলক ছোট সরবরাহকারীকে ক্রয়াদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে কারখানার কর্মপরিবেশ-সংক্রান্ত ত্রুটি যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। ফলে ছোট ও মাঝারি কারখানার বিপরীতে ক্রয়াদেশ কমছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বন্ধও হয়ে যাচ্ছে। তাজরীন ও রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হংকংভিত্তিক লি অ্যান্ড ফাং বাংলাদেশে তাদের সরবরাহকারী কারখানার সংখ্যা এরই মধ্যে অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে।