সিইটিপি নির্মাণেও ব্যবহার করা হয় মানহীন পণ্য। নতুন যন্ত্রপাতির স্থলে আমদানি করা হয়েছে নিন্মমানের পণ্য। এসব পণ্য গ্রহণ না করে সরবরাহকারীর বিল আটকে দেয়া হলেও রহস্যজনকভাবে সেই যন্ত্র ও যন্ত্রাংশই কর্তৃপক্ষের আপত্তি উপেক্ষা করে ব্যবহার হয়েছে।
অথচ একই চালানের ১৮ কনটেইনার নিন্মমানের পণ্য গত ১ বছরের বেশি সময় ধরে চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে আছে। ধারণা করা হচ্ছে, সিইটিপি স্থাপন প্রকল্পে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। সিইটিপি প্লান্টের এসব গুরুতর ত্রুটি ধরা পড়েছে ‘ট্যানারি শিল্প স্থানান্তও : পরিবেশ সংরক্ষণ ও জাতীয় উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল’ অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন।
এদিকে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান (বিসিক) সিইটিপি স্থাপনের বিভিন্ন পর্যায়ে আপত্তি জানিয়েছে। সংস্থাটি অভিযোগ করে মানবহির্ভূত ও ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আমদানি করায় ভবিষ্যতে গুরুতর সমস্যা দেখা দিতে পারে। শিল্প মন্ত্রণালয়ে দেয়া বিসিকের এক চিঠিতে এসব ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে প্রধানমন্ত্রী অগ্রাধিকারভুক্ত ও জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। এ সংক্রান্ত অভিযোগে দাবি করা হয়, প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন (পিএসআই) ছাড়াই চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান জেএলইপিসিএল-ডিসিএল-জেভি সিইটিপি নির্মাণে এসব যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাভার শিল্পনগরীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার বা সিইটিপি। এটি স্থাপনে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩৮ কোটি টাকা। কিন্তু কার্যক্রম শুরুর কয়েক মাসের মাথায় মাত্র ৩০ শতাংশ ট্যানারির বর্জ্যরে ব্যবস্থাপনাতেই জটিলতা তৈরি হয়েছে।
অথচ পূর্ণাঙ্গ পরিসরে কার্যক্রম শুরু করতে হলে আরও ১১২ ট্যানারিকে সাভারে যেতে হবে। তখন ঘটবে বড় ধরনের বিপর্যয়। এই সিইটিপি দিয়ে কোনোভাবেই সব ট্যানারির বর্জ্য শোধন করা সম্ভব হবে না। এতে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত একটি জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের সাফল্য ম্লান হওয়ার উপক্রম হয়েছে।এ সংক্রান্ত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থাপনা ঠিকঠাকভাবে চলছে না। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের তরল বর্জ্য শোধনের সর্বোচ্চ ক্ষমতা হচ্ছে ২৫ হাজার কিউবেক মিটার।
কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় সিইটিপি ব্যবস্থায় প্রস্তুতিকালীন বৃষ্টির পানির হিসাব করা হয়নি। ফলে চামড়া শিল্পনগরীতে বৃষ্টির মৌসুম এলেই কিংবা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু ঘন বৃষ্টিপাতে সিইটিপির পাইপলাইনে থাকা বর্জ্য পুরো এলাকায় ছড়িয়ে যাওয়ার সমূহ আশংকা রয়েছে। এর রিজার্ভ ট্যাংকের ধারণ ক্ষমতাও অনেক কম। কার্যক্রম শুরুতে এ ধরনের ত্রুটি নতুন ট্যানারি শিল্পের ভবিষ্যৎ অগ্রগতি নিয়ে শংকা দেখা দিয়েছে।
এছাড়া আন্তর্জাতিক পরিবেশ নীতিমালা অনুসরণ না করেই সাভার চামড়া শিল্পনগরীর সিইটিপি নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলে ঠিকঠাক কাজ করছে না সিইটিপি। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সিইটিপি থেকে নির্গত হওয়া প্রতি লিটার পানির তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানি বের হচ্ছে।
এছাড়া ক্ষারের পরিমাণ হওয়ার কথা ৬ মাইক্রোগ্রাম। কিন্তু পাওয়া গেছে ৮ মাইক্রোগ্রাম। দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকার কথা সাড়ে ৪ থেকে ৮ মাইক্রোগ্রাম। অথচ পাওয়া গেছে শূন্য দশমিক ২ গ্রাম। অন্যদিকে চামড়া শিল্পনগরীর পরিত্যক্ত ক্রোমিয়াম সমৃদ্ধ বর্জ্য ও অন্যান্য বর্জ্য সিইটিপির দুটি পৃথক পাইপলাইন দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কথা। কিন্তু কার্যত সেটি হচ্ছে না।
এছাড়া ট্যানারির সলিড ওয়াস্ট ব্যবস্থাপনায় কোনো সুবিধা রাখা হয়নি। উৎপাদন প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী সাধারণত এক টন কাঁচা চামড়া থেকে ২০০ কেজি পাকা চামড়া পাওয়া যায়। বাকি ৮০০ কেজিই বের হয় পানি ও সলিড ওয়াস্ট। কিন্তু এ বিপুল পরিমাণ পানি ও সলিড ওয়াস্টের সহজ নিষ্কাশনের সুযোগ নেই স্থানান্তরিত চামড়া শিল্পনগরীতে। এখানে একটি ডাম্পিং গ্রাউন্ড তৈরি হলেও তার নির্মাণেও অনুসরণ করা হয়নি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অনেক সময় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বর্জ্য শোধন না করেই সরাসরি নদীতে ফেলে দিচ্ছে। ফলে এর মাধ্যমে ধলেশ্বরী নদী মারাত্মকভাবে দূষিত হওয়ার পাশাপাশি এলাকার ভূগর্ভস্থ পানিও দূষণ করছে। যার প্রভাব ইতিমধ্যে পরিবেশের ওপর পড়তে শুরু করেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরীর নির্গত পানি পরীক্ষা করে পরিবেশ অধিদফতর জানতে পেরেছে, পানিতে মানবদেহের ও প্রাণীদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান ক্রোমিয়ামের পরিমাণ নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। পানির তাপমাত্রা থেকে শুরু করে দ্রবীভূত অক্সিজেন, ক্ষার, বিদ্যুৎ পরিবহন, ক্রোমিয়ামের পরিমাণ, লবণের পরিমাণ, রাসায়নিক উপাদান, জৈব রাসায়নিক উপাদানের পরিমাণ পরীক্ষা করা হয়েছে। অক্সিজেন ছাড়া বাকি সাতটি উপাদানের অস্তিত্বই নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। আর অক্সিজেনের পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।
জানা গেছে, হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে সরিয়ে নিতে ২০০৩ সালে ২০০ একর জায়গায় চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে সরকার। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সিইটিপি নির্মাণ বাবদ বরাদ্দ ৬৩৮ কোটি টাকা।
এর আওতায় ডাম্পিং ইয়ার্ড, এসটিপি, এসপিজিএস, সিসিআরইউ, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার কথা। বাকি ব্যয় ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন, সড়ক নির্মাণ, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ স্থাপনে ব্যয় হচ্ছে। এছাড়া মালিকদের ক্ষতিপূরণ বাবদ ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। জানতে চাইলে সাভার চামড়া শিল্পনগরীর সদ্য বিদায়ী প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো. আবদুল কাইয়ুম যুগান্তরকে বলেন, চামড়া শিল্পের জন্য এত বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের নজির সাভারেই প্রথম। প্রকল্পটি যখন গ্রহণ করা হয়েছে তখন এর ব্যয়ও কম ধরা হয়েছে। অভিজ্ঞতারও অভাব ছিল।
কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। সমস্যা থাকলে সেটি সমাধানও সম্ভব। মানহীন পণ্য ব্যবহারের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চীনা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এমন কাজ করেছিল। কিন্তু চালানের বিপরীতে বিল আটকে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি কনসাইনমেন্ট পিএসআই হওয়ার শর্তসাপেক্ষে তা সিইটিপিতে ব্যবহার করা হয়েছে। এরপরও যে মরিচার কথা বলা হচ্ছে. সেটি অস্বাভাবিক কিছু নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, সিইটিপিতে বর্জ্য পরিশোধনের জন্য উচ্চমাত্রার কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। চামড়ার বর্জ্যরে দূষণের মাত্রাও প্রকট। তাই কিছু সরঞ্জামে ডিসকালার হতেই পারে। সেগুলো পরিবর্তন করারও সুযোগ রয়েছে। এ নিয়ে উদ্বেগ হওয়ার কিছু নেই।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এটিই হচ্ছে সাভারে স্থানান্তরিত বিসিক চামড়া শিল্পনগরীর প্রকৃত চিত্র। শুধু এটিই নয়, এখনও এর নির্মাণ কাজই শেষ হয়নি। তা সত্ত্বেও সরকার, আদালত ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো ট্যানারি তাড়াতে অব্যাহত চাপ দিচ্ছে। সেটি কতটা যৌক্তিক ও নৈতিক তা সরকারকে ভেবে দেখতে হবে।
তবে ভিন্নমত প্রকাশ করে বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস ফুটওয়্যার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন বলেন, সাভার বিসিক চামড়া শিল্পনগরীতে অনেক ভুল-ত্রুটি রয়েছে। কাজ করতে গেলে ত্রুটি থাকবে। সেটি সমাধানও করা হবে। তার মানে এই নয়, এই কারণে ট্যানারি স্থানান্তর ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা সেটি আর হতে দিতে পারি না। সরকার এবং আদালত আমাদের অনেক মানবিকতা দেখিয়েছে। সমস্যা থাকলে সেখানে গিয়েই মোকাবেলা করা যাবে বলে দাবি করেন তিনি।