প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানিতে একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে জার্মানি। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রথম আট মাসে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৩ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। একই সময়ে জার্মানিতে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৩ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে প্রায় ১৩ কোটি ডলার বেশি। মহাদেশভিত্তিক বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে অনেক আগেই আমেরিকা অঞ্চলকে পেছনে ফেলেছে ইউরোপ। তবে এর মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্র ঠিকই একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানিতে শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছিল। মূলত কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু বড় বায়ার বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ায় দেশটিতে তৈরি পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তৈরি পোশাক রপ্তানিতে জার্মানিতে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি যেখানে ১৮.২৫ শতাংশ সেখানে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি তো ধরে রাখতে পারেনি উল্টো আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি কমেছে ৭.৮৫ শতাংশ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রথম আট মাসে তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি হয়েছে ১৮ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। যদিও এ সময় রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৯ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রায় ৫.৬৪ শতাংশ কমলেও আগের অর্থবছরের তুলনায় তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ২.৮২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে জার্মানির বাজারে রপ্তানি বৃদ্ধিই মূলত তৈরি পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে।
গত অর্থবছরের একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার ও জার্মানিতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩ বিলিয়ন ডলারের। অর্থাৎ ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে যুক্তরাষ্ট্রে জার্মানির চেয়ে প্রায় ৭১ কোটি ডলারের বেশি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যেও কমেছে তৈরি পোশাক রপ্তানি। তৃতীয় এই গন্তব্যস্থলে প্রথম আট মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ৬.৯০ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে যুক্তরাজ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ২ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলারের, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।
শুধু ফেব্রুয়ারিতে জার্মানিতে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৪০ কোটি ৭৮ লাখ ৬৩ হাজার কোটি ডলারের। মূলত এ খাতের নিট পোশাকের চাহিদাই জার্মানিতে রপ্তানি বাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে মূলত ওভেন পোশাক (প্যান্ট, শার্ট, ট্রাউজার) আমদানি করে। ইউরোপের দেশগুলো করে নিট পোশাক (গেঞ্জি, সোয়েটার)। কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে নিটের চাহিদা বেড়েছে।
ইপিবি ও বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১৭ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার, যা মোট পোশাক রপ্তানির ৬১ শতাংশ। এ সময় রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয় ১১.৬৩ শতাংশ। তবে এবার ইউরোপের বাজারে আগের রপ্তানি প্রবৃদ্ধিকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। পক্ষান্তরে গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৫ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৩৭ শতাংশ।
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সংশ্লিষ্টরা যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমার অনেক কারণের মধ্যে সবার ওপরে রাখছেন কমপ্লায়েন্স ইস্যুকে। ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর ইউরোপ ও আমেরিকাভিত্তিক ক্রেতাদের সংগঠন একর্ড ও অ্যালায়েন্স বাংলাদেশের গার্মেন্ট কারখানাগুলোর কমপ্লায়েন্স ইস্যুগুলোর ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে। এ সময় ছোট ও মাঝারি আকারের শত শত কারখানা টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে যায়। আবার যুক্তরাষ্ট্রে নিজ দেশের ক্রেতাদের সমালোচনার মধ্যে অনেক বড় বড় বায়ার বাংলাদেশ ছেড়ে নিজেদের ব্যবসা অন্য দেশে সরিয়ে নেয়। বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ‘পোলো রাল্ফ লরেন’-এর মতো অনেক নামিদামি ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে নিজেদের ব্যবসা পুরোপুরি গুটিয়ে নেয়। এরই প্রভাব পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে।
বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি আবু তৈয়ব বলেন, ‘কমপ্লায়েন্সের কারণে অনেক বায়ার বাংলাদেশ থেকে সরে গেছে। এ ছাড়া বেশ কিছু কারণে বাংলাদেশ আগের মতো প্রাইস কমপিটিটিভ নয়। আমাদের এখানে গভীর সমুদ্রবন্দর নেই। পোশাকের কাঁচামাল আমদানি ও তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া আমাদের চেয়ে ২০ থেকে ২৫ দিন এগিয়ে থাকে। ’ তবে এর মধ্যে সুখবর হচ্ছে বর্তমান ট্রাম্প সরকার ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) বাতিল করেছে। এই টিপিপির কারণে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া বাড়তি কিছু সুবিধা পেত। এই চুক্তি বাতিলের সুবিধা বাংলাদেশ নিতে পারে। আগামী জুন নাগাদ বাংলাদেশের অনেক কারখানা পুরোপুরি কমপ্লায়েন্স হয়ে উঠবে বলে তিনি মনে করেন।