তৈরি পোশাকের বিদেশি ক্রেতাদের জোট ‘অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের’ ভূমিকা রীতিমতো সরকারের আইন-কানুন ও পলিসিকে চ্যালেঞ্জ করছে। একটি স্বাধীন দেশে তাদের আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। তা সত্ত্বেও পোশাক কারখানায় কমপ্লায়েন্স (নিরাপদ কর্মপরিবেশের সূচক) বাস্তবায়নের নামে তারা ব্রিটিশ বেনিয়াদের মতো আচরণ করে যাচ্ছে। দেশের প্রচলিত বিধিবিধানের বাইরে এ চক্র নিজেদের সুবিধামতো দিকনির্দেশনা চাপিয়ে দিচ্ছে। এতে করে অহেতুক ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। অথচ পোশাকের দাম বাড়ানো নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
ভুক্তভোগী সূত্রগুলো বলছে, প্রকারান্তরে এভাবে তারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ গার্মেন্ট খাত ধ্বংস করার পাঁয়তারা করছে। অন্য কোনো দেশে তাদের এ ধরনের খবরদারি না থাকলেও বাংলাদেশে তারা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে জগদ্দল পাথরের মতো জেঁকে বসে আছে। তারা চাইছে, এভাবে এখানকার গার্মেন্ট ব্যবসা এক সময় বন্ধ হয়ে যাবে। এর ফলে বাংলাদেশের গার্মেন্ট ব্যবসার বাজার হাতছাড়া হবে এবং এতে ভিন্ন কোনো দেশ লাভবান হবে। কেউ কেউ মনে করেন, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি ষড়যন্ত্র। যারা বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সাফল্য চায় না, তারা এর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ২০১৮ সালের পর অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের কাজের মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না। আগামী বছরই সংস্থা দুটির কর্মকাণ্ড শেষ হচ্ছে। এদিকে যুগান্তরের তথ্যানুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের শোষণনীতি ছাড়াও আরও কয়েকটি কারণে বিশ্ববাজারে যৌক্তিক মূল্য পাচ্ছে না দেশের তৈরি পোশাক। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের অপপ্রচার, পোশাকের মূল্য কমাতে রানা প্লাজা ও আশুলিয়ার ঘটনাকে টেনে চাপ প্রয়োগ, মূল্য নির্ধারণে ক্রেতাদের অনৈতিক চর্চা, ব্রেক্সিট প্রভাব ও কতিপয় দেশীয় উদ্যোক্তার অশুভ প্রতিযোগিতা উল্লেখযোগ্য। সূত্র জানায়, অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। উদ্যোক্তারা বলছেন, এ দুটি জোটের পক্ষ থেকে গার্মেন্ট মালিকদের ওপর অস্বাভাবিকভাবে শর্ত জুড়ে দেয়া হচ্ছে। আর এটা করতে গিয়ে তারা দেশের আইন-কানুনকেও তোয়াক্কা করছেন না। যেমন একটি গার্মেন্ট ভবন ইমারত বিধিমালা মেনে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের অনুমতি সাপেক্ষে গড়ে উঠেছে। বছরের পর বছর ধরে ভবনটির সক্ষমতা বজায় আছে। কোনো সমস্যাও নেই। অথচ অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের পক্ষ থেকে ভবনটির সক্ষমতা নিয়ে শুধু প্রশ্ন তোলা হয় না, বরং ভবনের ফাউন্ডেশন সঠিক আছে কিনা তা নিশ্চিত করতে পিলারের ভিম খুঁড়ে রডের সংখ্যাও দেখতে চায়। প্রশ্ন হল- এভাবে যদি তাদের কাছে জবাবদিহি করতে হয় তাহলে সরকারের সংশ্লিষ্ট আইন-কানুন ও দফতরগুলো আছে কেন? কেননা ভবনের টেকসই নিশ্চিত করাসহ কারখানার অগ্নিনিরাপত্তা ও অন্যান্য বিষয়ের মানদণ্ড নিরূপণ ও তদারকি করার জন্য দেশে অভ্যন্তরীণ কর্তৃপক্ষ আছে। নিজস্ব আইনের অধীনে ভবন কোড, নকশা অনুসরণ করে তা নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া সার্বিক কমপ্লায়েন্স ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে বুয়েট, ফায়ার সার্ভিস, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বাণিজ্য, শ্রম মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে জাতীয় মানদণ্ড কমিটিও রয়েছে। কিন্তু অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্স কোনো কিছুই মানছে না। তাই অনেকে মনে করেন, তাদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল।
জানা যায়, কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়নের নামে এভাবে তাদের আবদার আর অজুহাতের শেষ নেই। এরপরও ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র মতো তাদের পছন্দ মোতাবেক নির্ধারিত কোম্পানির কাছ থেকে যন্ত্রপাতিসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কিনতে বাধ্য করা হয়। এতে সহজে বোঝা যায়, তারা এখানে এক ধরনের কমিশন বাণিজ্য করছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ যুগান্তরকে আরও বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের কার্যক্রম নেই। স্বাধীন দেশে ওদের কার্যক্রম দেখে প্রথমে খারাপ লেগেছে। কিন্তু শেষে এক অর্থে মনে হয়েছে, ফলাফলটা ভালো। কারণ শুরু থেকে মনে করা হতো কোনো পোশাক কারখানার কমপ্লায়েন্স নেই। সবগুলোই রানা প্লাজার মতো। কিন্তু অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৮শ’ কারখানা পরিদর্শন করে ত্রুটিপূর্ণ পেয়েছে মাত্র ৩৪টি, যা মোট কারখানার দু’শতাংশেরও কম। আন্তর্জাতিকভাবে এই মানদণ্ডের অনুপাতের হার দু’শতাংশের বেশি। ওই হিসেবে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অবস্থান ভালো আছে তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড অন ফায়ার সেফটি ইন বাংলাদেশের তথ্য মতে, বর্তমান দেশের ৭৫ শতাংশ পোশাক শিল্পই কমপ্লায়েন্সের আওতায় রয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্রিন সার্টিফায়েড প্রতিষ্ঠানের ঘোষণা অনুযায়ী বিশ্বের প্রথম ১০টি গ্রিন পোশাক কারখানার মধ্যে ৭টি বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে সর্বত্র। এসব ভালো উদ্যোগ থাকার পর বিশ্ববাজারে মূল্য বৃদ্ধিতে ইমেজ হিসেবে কাজে আসছে না। সংশ্লিষ্টদের মতে, এর কারণ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প নিয়ে নেতিবাচক প্রচার বেশি হচ্ছে।
সরেজমিন পরিদর্শনকালে গাজীপুর গ্রিন সার্টিফায়েড কারখানার এসকিউ গ্রুপের চিফ সাপ্লাই চেন অফিসার মো. আকরাম হোসেন বলেন, দেশে আন্তর্জাতিক মানের কারখানা থাকলেও বহির্বিশ্বে ইতিবাচক প্রচার নেই। তাই ইতিবাচক দিকগুলো বেশি প্রচার পেলে তৈরি পোশাকের মূল্য বৃদ্ধিতে পরোক্ষভাবে কাজ হতো।
বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প নিয়ে এক ধরনের অপপ্রচার দেখা গেছে নেদারল্যান্ডসে। গত ফেব্রুয়ারিতে আর্মসটাডাম ও হেগ সফরকালে দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন ফেডারেশন অব ট্রেড ইউনিয়ন অব লেদারল্যান্ডস (এফএনভি) ভুল তথ্য প্রচার করছে। সংগঠনের পলিসি অফিসার মিস. উলমা রোসের দেয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশের একটি পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে ৫শ’ শ্রমিকের বেশি মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ ঢাকার পাশে আশুলিয়ায় শ্রমিক আন্দোলনকে ঘিরে বলা হয়, উদ্যোক্তারা এ ঘটনায় প্রায় ১ হাজার শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব তথ্য বাংলাদেশের শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম ওই সংগঠনের কাছে সরবরাহ করেছেন। এতে প্রমাণিত হয়, একশ্রেণীর শ্রমিক নেতাও দেশের গার্মেন্ট ব্যবসার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এরা বিভিন্ন দেশের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। কেউ কেউ এনজিওর লেবাস লাগিয়ে মুখে শ্রমিকের স্বার্থের কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি নিজের আখের গোছাতে বেশি ব্যস্ত।
এদিকে অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরি কম দেয়ার তথ্য প্রচার করছে ‘ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন অব নেদারল্যান্ডস’ নামে একটি বিদেশি সংগঠন। অথচ ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, চীনসহ বিশ্বের কোনো দেশের শ্রমিকদের নিয়ে তারা এ ধরনের কথা বলছে না।
আর্মসটাডামে অ্যাকর্ডের অফিস পরিদর্শনকালে হেড অব পাবলিক অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড স্টেকহোল্ডার জওরিস ওলদেনাজ মজুরি বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, গত তিন বছরে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ২১ শতাংশ। কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি সে অনুপাতে বাড়েনি। এসব কারণে ঢাকার আশুলিয়া এলাকায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের বড় ধরনের আন্দোলন হয়।
অথচ যুগান্তরের অনুসন্ধানে মূল্যস্ফীতি সংক্রান্ত তথ্যের সত্যতা মেলেনি। দেখা গেছে, সরকারের হিসাবে গত তিন অর্থবছরে (২০১৪-১৬) গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১৯ দশমিক ৬০ শতাংশ। এছাড়া শ্রমিকদের মজুরিও বেড়েছে।
অপরদিকে পোশাকের সঠিক মূল্য না পাওয়ার পেছনে যোগ হয়েছে ইউরোপের ব্রেক্সিট (ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে আসা) এর নেতিবাচক প্রভাব। দেশটির ব্রেক্সিট ঘোষণার পর ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের দর কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ, যা যুক্তরাজ্যের আমদানি ব্যয়কে বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে ওই দেশের ক্রেতারা আরও কম দামে পণ্য তৈরির জন্য বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের চাপ দিচ্ছেন।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, দাম কমাতে যুক্তরাজ্যের চাপটা একটু বেশি। পাউন্ড দুর্বল হওয়ার কারণে দাম কমিয়ে সমন্বয় করতে চাচ্ছে।
এনভয় গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, পাউন্ডের দরপতনে ব্যবসার খরচ বাড়ায় ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছে। তবে সেটা আরও কম দামে পণ্য বানিয়ে নিতে। এটাই তাদের কৌশল।
এদিকে পোশাকের মূল্য নির্ধারণে অনৈতিক চর্চা হচ্ছে বলে অভিযোগ একাধিক উদ্যোক্তার। তাদের মতে, বিদেশি ক্রেতারা প্রথমে কয়েকটি ফ্যাক্টরি থেকে মূল্য তালিকা সংগ্রহ করেন। এসব তালিকায় পৃথকভাবে কাপড়, সুতা, সেলাই, মজুরিসহ অন্যান্য উপকরণের মূল্য দেয়া থাকে। প্রতিটি তালিকার সবচেয়ে কম মূল্যের উপকরণগুলো নিয়ে আলাদাভাবে ক্রেতারা একটি তালিকা তৈরি করেন। এভাবে তারা উদ্যোক্তাদের মূল্য অফার করছে। এটি এক ধরনের অনৈতিক চর্চা বলে আলিফ ফ্যাশন ডিজাইন লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মো. হাতেম জানান। তার মতে, চীন সরকার তৈরি পোশাকের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সর্বনিন্ম একটি সিলিং বেঁধে দিয়েছে। এর ফলে ক্রেতারা ওই দেশের উদ্যোক্তাদের জিম্মি করতে পারে না। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে বাংলাদেশেও এ ধরনের সর্বনিন্ম মূল্য সিলিং বেঁধে দেয়া।
মূল্য না পাওয়ার আরও একটি কারণ হিসেবে নেদারল্যান্ডসের চেইন ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির উদ্যোক্তা ও বিদেশি ক্রেতা হুসেইন গুলারের মতে, বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা অনেক বেশি বিনিয়োগ করেছেন পোশাক শিল্পে। এতে পরিচালনা ব্যয় বেড়ে গেছে। তা মেটাতে গিয়ে কম দামে পোশাক তুলে দিচ্ছেন ক্রেতাদের হাতে। এজন্য এখানে দ্রুত সিলিং বেঁধে দেয়া জরুরি। তাহলে যারা ভালো মানের গার্মেন্ট পণ্য তৈরি করছেন তাদের মূল্যায়িত হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
অভিযোগ উঠেছে, পোশাকের দরদাম নির্ধারণের সময় কৌশল হিসাবে বিদেশি ক্রেতারা রানা প্লাজা ও আশুলিয়ার তাজরিন গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি এখনও অহেতুক টেনে আনছেন। এ অজুহাতে তারা দাম কমাতে চাপ প্রয়োগ করেন। অথচ রানা প্লাজা ঘটনার পর পোশাক শিল্পে ব্যাপক সংস্কার হয়েছে। অথচ এ বিষয়টি সামনে আনা হচ্ছে না। আর এক্ষেত্রে ক্রেতা জোটের সংগঠন অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের আচরণ অনেকটা অন্ধ সেজে বসে থাকার মতো।