পোশাকের বৈশ্বিক বাজারে পণ্যের ধরন আছে সহস্রাধিক। সেখানে স্বল্পমূল্যের টি-শার্ট যেমন আছে, তেমনি আছে উচ্চমূল্যের ওভার কোট, স্যুট ও ডেনিম জ্যাকেট। প্রায় ১ লাখ কোটি ডলারের এ বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় হলেও তা গুটিকয়েক পণ্যনির্ভর। এক দশক ধরে দেশের প্রধান রফতানি পণ্য টি-শার্ট। পণ্য বহুমুখীকরণ ও বৈচিত্র্যের পরিবর্তে টি-শার্টের ওপর অতিনির্ভরতার কারণে খাতটির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা।
রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর (২০১৫-১৬) বিদেশে পণ্য রফতানি থেকে বাংলাদেশের আয় হয়েছে ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে পোশাক পণ্য রফতানি থেকে এসেছে ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। আর পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, গত অর্থবছর টি-শার্ট থেকে রফতানি আয় হয়েছে ৬১১ কোটি ডলার। সংগঠনটির গত এক দশকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণেও রফতানিতে টি-শার্টের আধিপত্য দেখা গেছে।
দেশের রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশই আসে পোশাক খাত থেকে। গত চার দশকে শিল্পটি ধীরে ধীরে অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ চালিকাশক্তির ভিত মূলত পাঁচ-ছয়টি পণ্য। রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও পোশাক শিল্প-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে মূলত দুই ক্যাটাগরিতে পোশাক রফতানি হয়। এর একটি নিট, অন্যটি ওভেন। এ দুই ক্যাটাগরিতে মূলত পাঁচ ধরনের পণ্য রফতানি করেন পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকরা। এগুলো হলো— টি-শার্ট, ট্রাউজার, শার্ট, জ্যাকেট ও সোয়েটার। তৈরি পোশাক খাতে মোট রফতানির ৮০ শতাংশেরই বেশি দখল করে রেখেছে এ পাঁচ পণ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) তথ্য বলছে, বাংলাদেশ পাঁচ ধরনের তৈরি পোশাক পণ্য বেশি রফতানি করলেও এর প্রায় ৫০ শতাংশই হলো টি-শার্ট ও ট্রাউজার। ২০০৯-১০ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত মোট সাত বছরে বাংলাদেশের পোশাক রফতানির তথ্য পর্যালোচনা করেছে ইউএসডিএ। এতে দেখা গেছে, গত সাত বছরে পাঁচটি পণ্যই মোট পোশাক রফতানির প্রায় ৮০ শতাংশ স্থান দখল করে আছে।
মৌলিক এ পাঁচটি পণ্য উৎপাদনই বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের মূল সক্ষমতা। ৪০ বছর ধরে এসব মৌলিক পণ্য ঘিরেই শিল্পোদ্যোক্তারা নিজেদের সক্ষমতা বাড়িয়েছেন। কিন্তু যেকোনো শিল্পকে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই করতে এ পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক কোনো ইঙ্গিত বহন করে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, মৌলিক বা লো-এন্ড পণ্য উৎপাদন সক্ষমতার পাশাপাশি হাই-এন্ড পণ্য উৎপাদন সক্ষমতা না বাড়লে কোনো শিল্পই দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারে না।
তবে বাংলাদেশের পোশাক খাতের ভবিষ্যৎ শুধু টি-শার্ট ও ট্রাউজারে আটকে থাকবে না বলে মনে করেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। কারণ কারখানার মানোন্নয়নে এখন বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ হচ্ছে। এ বিনিয়োগ করতে গিয়ে অনেক কারখানা মালিকই দামি পণ্য তৈরির উপযুক্ত প্রযুক্তি স্থাপন করছেন। আবার টি-শার্ট ও ট্রাউজারে আরো বেশি মূল্য সংযোজন কীভাবে করা যায়, সেদিকেও মনোযোগী হয়েছেন উদ্যোক্তারা। তবে এক্ষেত্রে পোশাকে নকশা তৈরির ক্ষেত্রে স্থানীয় সক্ষমতার ঘাটতি আছে। আর ক্রেতাদের চাহিদানির্ভর হওয়ার কারণে নকশায় নিজস্ব মতামত দেয়ারও সুযোগ কম বলে জানিয়েছেন তারা।
নিট পোশাক পণ্য প্রস্তুতকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর পরিচালক আসাদুল ইসলাম বলেন, পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ শুধু টি-শার্ট ও ট্রাউজারে আটকে নেই। এখন বিশ্বব্যাপী যেসব পণ্যের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো ফাংশনাল ফ্যাব্রিক ও পণ্য। এ পণ্যগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলো বিশেষ কাজে প্রয়োজন হয়। এখন এমন কাপড় তৈরি হচ্ছে, যেগুলো থেকে তৈরি পোশাক পরলে শরীরের ব্যথা সেরে যাবে। আবার ঘাম দ্রুত ঝরে যাবে, এমন পোশাকও তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ এ ধরনের পোশাক ভবিষ্যতে তৈরি করবে। তবে এজন্য যে উদ্ভাবনী দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ প্রয়োজন, তা আমাদের নেই। ফ্যাশন ডিজাইন ইনস্টিটিউট থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। সরকারের উচিত পোশাক শিল্পের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে মনোযোগী হওয়া।
তৈরি পোশাক শিল্পের মূল পণ্য সাধারণ টি-শার্ট ও প্যান্ট। গত এক দশকে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সোয়েটার। আর ফ্যাশন ও হাই ভ্যালু পণ্যগুলো হলো ওভার কোট, ডেনিম জ্যাকেট, শার্ট ও প্যান্ট, স্যুট, সিঙ্গলেট, এমব্রয়ডার্ড শার্ট। গত কয়েক বছরে উচ্চ মূল্যের ডেনিম পণ্য উৎপাদন বাড়লেও তা মোট পোশাক রফতানি বাড়াতে পারেনি ব্যাপক হারে।
উচ্চ মূল্যের পোশাক পণ্য উৎপাদন কম হওয়ার পেছনে দেশে তৈরি পোশাক কারখানাগুলোয় দক্ষ মানবসম্পদের সংকটকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর গবেষণা বলছে, প্রয়োজনের তুলনায় শ্রমিকের ঘাটতি আছে ২০-২৫ শতাংশ। আবার শ্রমিক যারা আছে, তাদের মধ্যে হাই ভ্যালু পণ্য তৈরির দক্ষতা নেই।
ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, ডেনিম পণ্য উৎপাদন সামর্থ্য গত কয়েক বছরে বেড়েছে ব্যাপক হারে। এখন অনেক উচ্চ মূল্যের পণ্য উৎপাদন হচ্ছে বাংলাদেশে। ডেনিম পণ্যে বাংলাদেশের নিজস্ব ব্র্যান্ডও এখন বিক্রি হচ্ছে বিশ্ববাজারে। পোশাক খাতের ভবিষ্যৎ তাই শুধুই টি-শার্ট বা বেসিক ট্রাউজারে সীমাবদ্ধ থাকছে না।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূল্য সংযোজন বেশি করে, এমন দামি বা হাই-এন্ড পণ্য তৈরির সামর্থ্য আছে উদ্যোক্তাদের। কিন্তু আর্থিক ঝুঁকি ও নানা অবকাঠামো দুর্বলতায় সামর্থ্যের পূর্ণ ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে না। ফলে হাই-এন্ড বা বেশি দামের পণ্য তৈরি করতে না পেরে মূল্য সংযোজনেও পিছিয়ে পড়ছেন তারা।
তবে দামি পণ্য বাংলাদেশ তৈরি করতে পারছে না, এ তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, তৈরি পোশাক খাতটি এত বড় হয়েছে ক্রেতা ও প্রস্তুতকারকের আস্থার ওপর। কাজ করতে করতে একটি কারখানার ওপর আস্থা বাড়লেই ক্রেতারা ধীরে ধীরে দামি পণ্যগুলোর অর্ডার দিতে থাকেন।
দামি পোশাক তৈরিতে প্রক্রিয়া থাকে বেশি। একটি ডেনিম পণ্যের পিসপ্রতি ফ্রেইট অন বোর্ড (এফওবি) মূল্য পাওয়া যায় ১৫-২০ ডলার। দাম বেশি বলেই এটি তৈরিতে প্রক্রিয়া থাকে বেশি। যেমন ওয়াশ, এমব্রয়ডারি, প্রিন্ট, ডায়িং, স্পেশাল মেটাল বাটন। তৈরি পোশাকে দেশের বেশির ভাগ কারখানায় সব সুবিধা থাকে না। এসব ক্ষেত্রে একটি কারখানায় কাটিং ও সুইং থাকে। এর পর ওয়াশ, এমব্রয়ডারি, প্রিন্ট, ডায়িং, স্পেশাল মেটাল বাটন লাগানোর মতো প্রক্রিয়াগুলোর জন্য যেতে হয় ভিন্ন ভিন্ন কারখানায়। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। ফলে ক্রেতার দেয়া এফওবির সুবিধা কাজে লাগাতে পারেন না প্রস্তুতকারকরা।
পোশাক খাতের সংযোগ শিল্প হিসেবে নব্বইয়ের দশকে হস্তচালিত কিছু মেশিনারি দিয়ে যাত্রা হয় এমব্রয়ডারি শিল্পের। পোশাক শিল্পের ১ ডলারের একটি সাধারণ টি-শার্ট এমব্রয়ডারি করা হলে মূল্য সংযোজিত হয়ে চার-পাঁচ গুণ দামে বিক্রি হয়। এভাবেই মূল্য সংযোজন শুরু হয়েছে পোশাক খাতে। কিন্তু টি-শার্ট ও ট্রাউজার উৎপাদন আধিক্য থেকে এখনো বের হতে পারেননি উদ্যোক্তারা।
মূল্য সংযোজনের জন্য দেশে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোয় ঘাটতি আছে, এমন মন্তব্য করেছেন রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি ও এনভয় গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম মুর্শেদী। তিনি বলেন, উদ্যোক্তারা কারখানায় বিনিয়োগ বাড়াতে পারেন। কিন্তু বিদ্যুৎ ব্যবহারও সে পরিমাণে বাড়বে। কিন্তু বিদ্যুতের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে বিনিয়োগ বাড়ালেও অতিমূল্য সংযোজিত পণ্য তৈরির প্রতি আগ্রহ থাকছে না।
ইপিবি বলছে, বাংলাদেশের রফতানি খাতে বহুমুখিতার ঘাটতি অনেক দিন ধরেই। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। তবে তা রাতারাতি সম্ভব নয়। কারণ পোশাকের বৈশ্বিক বাজার বিবেচনা করলে মৌলিক পণ্যের চাহিদা সবসময়ই আছে এবং থাকবে। অর্থনৈতিক মন্দায়ও এ ধরনের পণ্যের চাহিদা কমে না।
জানতে চাইলে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান মাফরূহা সুলতানা বণিক বার্তাকে বলেন, পোশাক খাত ধীরে ধীরে বহুমুখী হচ্ছে। এ শিল্প-সংশ্লিষ্টরা ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের যে লক্ষ্য নিয়েছেন, তা অর্জনের জন্যই খাতটিকে বহুমুখী করতে চাইছেন তারা। যে ধরনের পণ্য আমাদের শিল্পোদ্যোক্তারা তৈরি করেন, সেগুলোর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। আর তা হলো, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায়ও এ ধরনের পণ্যের চাহিদা কমে না, যার কারণে বৈশ্বিক মন্দায় বাংলাদেশের রফতানি খাতে খুব একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। তবে এখানে আরো মূল্য সংযোজন করতে হবে। এ লক্ষ্যে শিল্প মালিকরা এখন বৈচিত্র্যময় পণ্য তৈরি করতে শুরু করেছেন। সরকারের তরফ থেকেও বিভিন্ন নীতিগত সহায়তা দেয়া হচ্ছে। শুধু টি-শার্ট ও ট্রাউজারে পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ আটকে থাকবে না, এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।