২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজার মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর থেকে দেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত গার্মেন্টস শিল্পে সঙ্কট লেগেই আছে। নানামুখী সঙ্কটে প্রতিদিনই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কোনো-না-কোনো গার্মেন্টস কারখানা। কখনও অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের চাপিয়ে দেওয়া শর্ত, কখনও রফতানি আদেশ না থাকা, আবার কখনও মালিকের আর্থিক সঙ্কটের কারণে কারখানা বন্ধ হচ্ছে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর থেকে এ পর্যন্ত ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এবং আশপাশের এলাকার প্রায় দেড় হাজার গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তৈরি পোশাক খাতের দুই সংগঠন বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। বন্ধ কারখানার মধ্যে বিজিএমইএ’র সদস্য কারখানা ১২শ’এবং বিকেএমইএর সদস্যভুক্ত কারখানা ৩০০টি। তবে এসব কারখানার মধ্যে পাঁচ শতাধিক কারখানা অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা হলেও বাকি প্রায় ১ হাজার কারখানা একেবারেই হারিয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সকালের খবরকে জানান, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর কারখানা সংস্কার, বিদেশি ক্রেতার চাপ, বিশ্ববাজারে পোশাকের দরপতন, টাকার বিপরীতে ডলারের অবমূল্যায়ন, শ্রম অসন্তোষ, শেয়ার্ড বিল্ডিং (একই ভবনে অন্য খাতের প্রতিষ্ঠান)-এ ধরনের সমস্যায় পড়ে গত চার বছরে বিজিএমইএ’র সদস্যভুক্ত প্রায় ১২শ’কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে দেশের প্রধান রফতানি আয়ের খাত পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম হচ্ছে। আগে যেখানে পোশাক রফতানিতে ১৮ থেকে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সেখানে এখন হচ্ছে মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ। তবে আশার কথা হচ্ছে, গত চার বছরে দেশে অনেক বিশ্বমানের পোশাক কারখানা হয়েছে। কারখানা কমপ্লায়েন্স ও শ্রমিকদের জীবনমানের নিরাপত্তা অনেক বেড়েছে। এগুলো ইতিবাচক দিক। জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি এ বিষয়ে সকালের খবরকে জানান, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর গত ৪ বছরে ছোট-মাঝারি প্রায় দেড় হাজার কারখানা বন্ধ হয়েছে। তবে এর মধ্যে ৫০০ কারখানা স্থানান্তরিত হলেও প্রায় এক হাজার কারখানা অন্য জায়গায় স্থানান্তর করতে না পারায় সেগুলো একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। আর এসব কারখানা বন্ধের কারণে চাকরি হারিয়েছে দেড় লক্ষাধিক শ্রমিক। ঢাকার বাড্ডা, মিরপুর, নারায়ণগঞ্জ ও আশুলিয়া এলাকায় এসব কারখানা বেশি ছিল। বিদেশি ক্রেতারা কাজ না দেওয়ায় কারখানার মালিকরা কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে। তিনি আরও জানান, বর্তমানে কারখানা কমপ্লায়েন্স প্রায় শতভাগে পৌঁছেছে। নিরাপত্তাও বেড়েছে শ্রমিকদের। তবে এখনও অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিজিএমইএ’র তথ্যানুসারে সংগঠনটির নিবন্ধিত তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা ৬ হাজার ১৯৬টি। এর মধ্যে বিভিন্ন সময় নানা কারণে ১ হাজার ৭৬৫টি কারখানা বন্ধ করা হয়েছে সংগঠনটির নিজস্ব উদ্যোগে। এসব কারখানা বাদ দিলে নিবন্ধিত কারখানার সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ হাজার ৪৩১টি। এর মধ্যে সক্রিয় কারখানার সংখ্যা ৩ হাজার ৫০০টি। আর সরাসরি রফতানি করে এমন কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ২০০। বাকি ১৫শ’ কারখানা চালু থাকলেও এরা বিজিএমইএ থেকে ইউডি (ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন) সুবিধা নেয় না। মূলত এসব কারখানা সাব কন্ট্রাকটিংয়ে কাজ করে। সম্প্রতি কারখানা বন্ধ করেছেন এমন কয়েকজন উদ্যোক্তার মধ্যে রাজধানীর মহাখালীর রসুল বাগের টেক্সট পোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরহাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, ১৯৯২ সাল থেকে তিনি তৈরি পোশাক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কারখানা কমপ্লায়েন্স করতে না পারায় গত ১৫ এপ্রিল তিনি কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। তিনি জানান, একসময় আমেরিকা, ইউরোপ এবং কানাডার বায়ারদের সঙ্গে কাজ করলেও বর্তমানে কাজ না থাকায় কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। তবে তাকে ব্যাংকের কোটি টাকার ঋণের দায় নিয়ে বন্ধ করতে হয়েছে। তার এই কারখানায় তৈরি হতো শার্ট এবং প্যান্ট। তিনি আরও জানান, একই ভবনে থাকা আরও সাতটি কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়েছে একই কারণে। নতুন করে বিনিয়োগে গেলেন না কেন জানতে চাইলে ফরহাদ হোসেন জানান, ঢাকার বাইরে বিনিয়োগ করতে হলে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা দরকার। ফলে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো সমস্যা না হলেও বন্ধ হচ্ছে ছোট-মাঝারি কারখানা। তিনি জানান, অধিকাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারী কারখানা বন্ধ করে এ ব্যবসা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে ফ্যাশন নেট ওয়ার্ক নামে একটি কারখানার মালিক জুয়েল আলী জানান, ইতোমধ্যে তার পুরনো প্রতিষ্ঠান ফ্যাশন নেট ওয়ার্ক বন্ধ করে বেলা ফ্যাশন নামে গাজীপুরে কারখানাটি স্থানান্তর করেছেন। এতে প্রায় ৩০ কোটি টাকা তাকে বিনিয়োগ করতে হয়েছে। কিন্তু নতুন করে বিনিয়োগে কারখানা প্রতিষ্ঠার পরও তেমন সুবিধা করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি গাজীপুরের মাওনায় বন্ধ হওয়া কারখানা টোপাজ ড্রেসেসের পরিচালক আরফিন আনাম বলেন, কারখানার ব্যবস্থাপনাগত ঘাটতির কারণে মাত্র দেড় বছর আগে চালু করা কারখানা বন্ধ করতে হল। এতে আমি মানসিকভাবে খুবই হতাশ। তিনি বলেন, নির্ভরযোগ্য এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনা না হলে বর্তমান পোশাক খাতে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। সার্বিক বিষয়ে বিজিএমইএ সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর একদিকে যেমন কারখানা বন্ধ হয়েছে, অন্যদিকে এ খাতে নতুন বিনিয়োগও হয়েছে। গত চার বছরে বিজিএমইএ সদস্য এমন নতুন কারখানা হয়েছে ৬৭৪টি। ৩০০ থেকে ৫০০ মেশিনের এসব কারখানা প্রতিটিতে বিনিয়োগ হয়েছে ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা। এটা ভালো দিক। তবে রানা প্লাজার পর পোশাক শিল্পের ওপর যে ঝড় বয়েছে তার কারণে অনেক উদ্যোক্তা ঝরে গেছে এ খাত থেকে। এখনও যারা ছোট ও মাঝারি গার্মেন্টস কারখানার উদ্যোক্তা রয়েছেন তাদের টিকে থাকতে হচ্ছে অনেক সংগ্রাম করে।
বন্ধ হচ্ছে একের পর এক গার্মেন্টস কারখানা
রানা প্লাজা ধসের সঙ্কট চলছেই